

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পর প্রায় সাড়ে ছয় মাস পার হলেও কাজ শেষ করতে পারেনি তারা।
আবার নির্বাচনী রোডম্যাপে বর্ণিত সময়সীমার মধ্যেও দল নিবন্ধনের চূড়ান্ত গেজেট প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি ইসির পক্ষে। এতে বিশেষ করে নিবন্ধনপ্রত্যাশী দলগুলোর তোপের মুখে পড়েছে সাংবিধানিক এই সংস্থাটি।
ক্ষুব্ধ দলগুলো বলছে, অন্যদের নিবন্ধন আটকে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) অগ্রাধিকার দিচ্ছে ইসি। অর্থাৎ এনসিপির জন্য অন্যদের নিবন্ধন আটকে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে প্রয়োজনে আদালতেও যাবে তারা। যদিও ইসি থেকে বলা হচ্ছে, এক সপ্তাহের মধ্যে নিবন্ধনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এর আগে ১০ মার্চ নিবন্ধন আগ্রহী নতুন দলের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করে ইসি। একদফা সময় বাড়ানোর পর ২২ জুনের মধ্যে ১৪৩টি দল আবেদন করে। তবে নিবন্ধন শর্ত পূরণে ব্যর্থতায় প্রাথমিক বাছাইয়ে ঝরে পড়ে ১২১টি দল। বাকি ২২টি দলের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত চালায় ইসি গঠিত কমিটি।
এদিকে, গত ২৮ আগস্ট নির্বাচনী পথরেখা তথা রোডম্যাপ ঘোষণা করে ইসি। যেখানে বলা হয়েছিল, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক নিবন্ধনের কাজ শেষ করা হবে। আর ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে ইসি। এই অবস্থায় ৩০ সেপ্টেম্বর গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে ইসি জানায়, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়েছে। এই দুটি দল ছাড়াও নিবন্ধনের সম্ভাব্য তালিকাভুক্ত আরও ১০টি রাজনৈতিক দলের তথ্য-উপাত্ত ‘অধিকতর তদন্ত' করাচ্ছে কমিশন।
নিষ্ক্রিয় দুটি দলকে নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রাখায় প্রশ্ন উঠেছে-
নিবন্ধন নিয়ে ইসি'র এমন সিদ্ধান্ত শুরুতেই প্রশ্নের মুখে পড়ে। খোদ ইসি'র তদন্ত কর্মকর্তারাই প্রতিবেদন দিয়েছেন, এনসিপি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও অন্য দল দু'টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অস্তিত্ব ও কার্যকারিতা নেই। নিষ্ক্রিয় দল দুটিকে নিবন্ধনের প্রক্রিয়ায় রাখায় প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের সঙ্গে দেখা করে এনসিপির নেতারা জাতীয় লীগের নিবন্ধনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানিয়ে আসেন।
একই সময় থেকে এনসিপিকে ‘শাপলা’ প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে ইসি। শাপলা প্রতীক বরাদ্দ পেতে এনসিপির অনড় অবস্থান ও কয়েক দফা চিঠি পাঠানোর মধ্যে তালিকায় না থাকায় সেটি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় তারা।
ইসি'র জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের তালিকার বাইরে গিয়ে প্রতীক দেওয়ার আর সুযোগ নেই। ইসির সিদ্ধান্তও পরিবর্তন হয়নি।
এরই মধ্যে ইসির নির্ধারিত তালিকা থেকে বিকল্প প্রতীক বাছাইয়ের জন্য এনসিপিকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু সেটি না করে দলটি সেদিন নির্বাচন কমিশনে গিয়ে আবারও শাপলা প্রতীকের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়ে আসে। সর্বশেষ বুধবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম আবারও বলেছেন, ‘শাপলা প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না তারা।’ নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইসির পুনর্গঠন দাবিও করেছেন দলটির নেতারা।
জাতীয় লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) প্রাথমিক নিবন্ধন নিয়ে অভিযোগ ওঠার মধ্যেই অক্টোবরের মাঝামাঝি ফের তদন্তে নেমেছে ইসি। নিবন্ধনের পথে টিকে থাকা অন্য ১০টি দলের মাঠপর্যায়ের তথ্যও পুনরায় তদন্ত করে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নতুন করে তদন্তের আওতায় আনা দলগুলো হচ্ছে- আমজনতার দল, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভোলপমেন্ট পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, জনতার দল, মৌলিক বাংলা, জনতা পার্টি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি।
নিবন্ধনপ্রত্যাশী অনেক দলই ক্ষুব্ধ-
এদিকে, মঙ্গলবার ইসির মিডিয়া সেন্টারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে মৌলিক বাংলা এবং বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (বিজেডিডিপি) নেতারা অভিযোগ করেন, এনসিপিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ইসি অন্য দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রেখেছে। অধিকতর তদন্তের পরিবর্তে আগের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিবন্ধন সনদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে তারা।
মৌলিক বাংলার সাধারণ সম্পাদক ছাদেক আহমেদ সজীব বলেন, ‘ইসি এনসিপিকে বগলে নিয়ে ঘুরছে। তারা প্রথমে তদন্ত, পরে পুনঃতদন্ত, এখন আবার অধিকতর তদন্ত করছে। এতে আমাদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই তদন্ত আসলে রাজনৈতিক ময়নাতদন্তের মতো। আসলে এনসিপিকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ইসি তিন ধাপে তদন্ত চালাচ্ছে, যা ইসির নিজস্ব নীতিমালার লঙ্ঘন।’
বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির পক্ষ থেকে অধিকতর তদন্ত না করে প্রথম তদন্তের ভিত্তিতে নিবন্ধন দেওয়ার দাবি জানানো হয়। দলটির পক্ষ থেকে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের নিবন্ধন দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়ে আদালতে যাবেন তারা।’
জানতে চাইলে এ সংক্রান্ত ইসি গঠিত কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সমকালকে বলেছেন, ‘দলের নিবন্ধন বিষয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত আসবে। মাঠপর্যায়ের পুনঃতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়া মাত্রই পর্যালোচনা করে কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে।’