টানা ভারী বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলা ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই তিন জেলার প্রায় অর্ধলক্ষ গবাদিপশুর মৃত্যু হয়েছে। বন্যাকবলিত অন্য জেলা থেকে এই তিন জেলায় প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তিন জেলার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ৫৬ হাজার ৩৪৯টি গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া মারা গেছে। এর মধ্যে শুধু ফেনীতের মারা গেছে ৫৫ হাজার ২৫৪টি পশু। জেলায় গরু মারা গেছে ৩৮ হাজার ৭৩১টি, মহিষ মারা গেছে ৩৫৯টি। এছাড়া ১৫ হাজার ৫৫৮টি ছাগল ও ৬০৬টি ভেড়া মারা গেছে। এতে মোট ১৬ কোটি ৬৯ লাখ ৩৮ হাজার ২০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
নোয়াখালীতে মারা গেছে ১৬৭টি গরু, ৭৯টি মহিষ, ২০৯টি ছাগল ও ৪২৭টি ভেড়া। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তিন কোটি ৬২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। কুমিল্লায় ৩৫টি গরু, তিনটি মহিষ, ১৭১টি ছাগল এবং সাতটি ভেড়া মারা গেছে।
বন্যার পানি নেমে গেলেও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত গবাদি পশু মারা যাচ্ছে। যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এতে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন খামারিরা।
ফেনী সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়ার ৪০টি গরু আর ২২টি ছাগল নিয়ে ‘মরিয়ম ডেইরি’ বেশ ভালোই চলছিল। আগস্টের বন্যা তার সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে। বন্যার শুরুতে যখন খামারে পানি উঠে গেলে কিছু গরু-ছাগল অন্য জায়গায় সরাতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু পানিবন্দি অবস্থায় গো-খাদ্যের দারুণ সংকট দেখা যায়। কিছু গরু ও ছাগল রোগে আক্রান্ত হয়, বন্যার মধ্যে সঠিক চিকিৎসাও করানো যায়নি।
জাহাঙ্গীর বলেন, বন্যার মধ্যেই আমার নয়টা গরু, চারটা ছাগল মারা গেছে। নয়টা গরুর মধ্যে ছয়টাই গাভীন (সন্তানসম্ভবা) ছিল। দুইটা ছিল বাছুর। শনিবারও একটা গরু মারা গেছে। বাকি গরুগুলো নিয়েও চিন্তিত জানিয়ে তিনি বলেন, আমার অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে।
বন্যায় ক্ষতি মুখে পড়েছেন উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের ফতেহপুর গ্রামের খামারি আরিফ মোহাম্মদ রিয়াজ উদ্দিনও। তার খামারের ১৫টি গরুর মধ্যে ছয়টি এরই মধ্যে মারা গেছে। পানিতে ভেসে গেছে চারটি গরু, আর পানি নামার পর রোগে ভুগে মারা গেছে আরো দুটি।
জাহাঙ্গীর ও আরিফের মত হাজার হাজার খামারি বন্যার কারণে প্রচণ্ড ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেকে স্বপ্ন নিয়ে বিনিয়োগ করলেও তাদের সেই স্বপ্ন বন্যায় ভেসে গেছে। তারওপর ঘাড়ের ওপর পড়েছে ঋণের চাপ। খামার থেকে আয় না আসায় কীভাবে সেই ঋণ পরিশোধ করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন খামারিরা।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে অন্য দুই জেলার তুলনায় ফেনীর ক্ষতি অনেক বেশি। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ফেনীতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে দিনযাপন করেছেন। গ্রামীণ জনপদ থেকে এখনো সব পানি নামেনি। বন্যার এই ভয়াবহতার কারণেই সারাদেশ থেকে যত ত্রাণ গেছে তার বড় অংশ গেছে ফেনীর বানভাসি মানুষের জন্য।
ফেনী সদর উপজেলা সদরে প্রায় কয়েক শতাধিক খামারির গরুর মৃত্যু হয়েছে বলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ জানিয়েছে। সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম খোকন বলেন, সদর উপজেলায় বন্যার কবলে পড়ে ৩৮ হাজার ৩৫০টি গরু। যার মধ্যে রবিবার দুপুর পর্যন্ত মারা যায় ২৫ হাজার ৯৩৭টি। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।
তিনি বলেন, সদরে আক্রান্ত ৫৬টি মহিষের মধ্যে ১১টির মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত ১৬ হাজার ৭৮টি ছাগলের মধ্যে ৯ হাজার ৬৪৭টি মারা গেছে। আক্রান্ত শতাধিক ভেড়ার মধ্যে ৬০টির মৃত্যু হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বন্যার পানি নেমে গেলেও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিনিয়ত গবাদি পশু মারা যাচ্ছে। যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এটা আতঙ্কের। আমরা খামারিদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
সদরের পর বেশি ক্ষতি হয়েছে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায়। ফুলগাজীতে শুধু গরুর মৃত্যু হয়েছে সাত হাজার আর পরশুরামে তিন হাজার ২২৮টি।
ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের সাবেক সদস্য শহীদ বলেন, দরবারপুর গ্রামের মোহাম্মদ ইউসুফের চারটি গরু ছিল। বন্যার পানি বাড়তে শুরু করলে তিনি বাড়ি থেকে তিনটি গরুকে একটু উঁচু জায়গায় নিয়ে রাখতে পারেন। চতুর্থ গরুটি নিতে এসে দেখেন পানি অনেক বেড়ে গেছে। তখন প্রচণ্ড স্রোত ছিল। একটি গরু স্রোতে ভেসে যায়। গরুগুলোই ছিল তার বেঁছে থাকার সম্বল। একটি গরু ভেসে যাচ্ছে দেখে তিনি স্থির থাকতে পারেননি। গরু বাঁচাতে গিয়ে তিনিও সাঁতার দেন কিন্তু আর ফিরতে পারেননি। বানের পানিতে ভেসে যান। চারদিন পর ইউসুফের মরদেহ ভাটি থেকে উদ্ধার করা হয় বলে জানান সাবেক ইউপি সদস্য শহীদ।
ফেনী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ছয় উপজেলায় বন্যার কবলে পড়েছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮৮ গরু। ক্ষতিগ্রস্ত খামারের সংখ্যা তিন হাজার ২২টি। তিনি বলেন, যেসব গবাদিপশু বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে তাদের জরুরিভাবে চিকিৎসা ও ভ্যাকসিন নেয়া প্রয়োজন। প্রানিসম্পদ বিভাগ সব খামারির খোঁজ-খবর নিচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে।
এদিকে, বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। বন্যায় চারণভূমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পশুর খাবার দিতে পারছেন না তারা। খড় সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। অনেকে ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে খামার তৈরি করেছিলেন। বন্যায় খামারের পশু মারা যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এসব ঋণগ্রস্ত খামারিরা।
বন্যা পরবর্তী সময়ে নোয়াখালীতে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ছাগল। ইতোমধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গবাধিপশুর মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। সুবর্ণচরে ৭০ ভাগ ছাগল ও ভেড়া এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ প্রাণীই মারা যাচ্ছে।