প্রাচীণকাল থেকেই রাজা-বাদশাদের আমল থেকেই পান পাতায় আপ্যায়ন করা হতো
অতিথিদের। অতিথি আপ্যায়নের এক প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো পান পাতা।
শুধু তাই নয় যে কোনো মঙ্গলজনক কাজে এই পাতা না হলে সেই কাজ থাকত অসম্পূর্ণ। পানের কদর সেই সময় থেকে আজও এতটুকুও কমেনি।
পূজোপার্বন থকে শুরু করে যে কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি আজও বাঙালির রীতি-নীতির পরতে পরতে জায়গা জুড়ে রয়েছে পান পাতা।
সনাতন ধর্মের শাস্ত্র মতে, ব্রহ্মা তুষ্ট সুপারিতে, বিষ্ণু পানে এবং মহাবেদ চুনে। পানের খিলিতেই বাস করেন ত্রীদেব। তাই এই ধর্মে পান পাতার গুরুত্ব অপরিসীম।
এছাড়া মিথ রয়েছে পানের পাতা মাঝ বরাবর লম্বলম্বিভাবে না ছেঁড়ার। কিন্তু কীভাবে এই মিথ আসলো? চলুন জেনে নেয়া যাক আজকের আয়োজনে—
জরাসন্ধ নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন অনেক শক্তিশালী কুস্তিগীর ও যোদ্ধা। তার রাজ্য ছিলো ভারতের পূর্ব দিকে এবং তিনি মগদের রাজা ছিলেন। তার লক্ষ্য ছিলো সর্বত্র রাজ্য বিস্তার করা। তিনি খুব কঠোরভাবে রাজ্য পরিচালনা করতেন। কিন্তু শ্রী কৃষ্ঞ এমনটা চাননি। তাই তিনি সেখানে ছদ্মবেশে যান। তবে একপর্যায়ে তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যায়। তখন রাজ্য মীমাংসার জন্য জরাসন্ধকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানান কৃষ্ঞ। তখন জরাসন্ধ মনে মনে অনেক খুশি হলেন। কারণ তিনি ছিলেন অনেক শক্তিশালী এবং তার মৃত্যু রহস্য ছিলো লুকানো। তিনি ভাবলেন তার জয় নিশ্চিত। তাই রাজা জরাসন্ধ নিজেই বললেন— তোমরাই যুদ্ধের ধরণ ঠিক করো। তখন কৃষ্ঞ তাকে ভীমের সঙ্গে লড়তে বলেন। ভীমও বীর যোদ্ধা। তাই জরাসন্ধ যুদ্ধে রাজি হয়ে গেলেন। শুরু হলো বল্লম যুদ্ধ। এই যুদ্ধে যেন কেউই হার মানতে চায় না। চললো টানা ১৩ দিন। দুই জনই যুদ্ধে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। কিন্তু হার মানার লক্ষণ নেই কারোরই।
তখন কৃষ্ঞ জরাসন্ধকে দেখলেন তাকে যেভাবেই আক্রমণ করা হোক না কেন তার মৃত্যু হয় না। এমন পরিস্থিতিতে অসহায় যোদ্ধা ভীমও। তখন জরাসন্ধের মৃত্যু রহস্য খুঁজতে থাকেন কৃষ্ঞ। তখন তিনি জানতে পারেন জরাসন্ধ বর (আশির্বাদ) পেয়েছিলেন। তাকে দুই ভাগে না চিরলে মৃত্যু হবে না। কৃষ্ঞ সেখানে বসে বসে পান খাচ্ছিলেন। তখন একটি পান নিয়ে তিনি লম্বালম্বিভাবে চিরে ফেলেন। এটি দেখে যোদ্ধা ভীম বিষয়টি বুঝতে পারেন। তখন ভীম জরাসন্ধের দুই পা ধরে লম্বালম্বিভাবে চিরে ফেলেন এবং দুই দিকে সেটিকে ছুঁড়ে মারেন। এতে জরাসন্ধের মৃত্যু হয়।
যে কারণে জরাসন্ধ বর পেয়েছিলেন—
জরাসন্ধের পিতার নাম রাজা বৃহদ্রথ। জরাসন্ধের পিতা রাজা বৃহদ্রথের বিয়ে হয়েছিল কাশীর রাজার যমজ দুই কন্যার সঙ্গে। রাজা তার দুই স্ত্রীকেই সমান ভালোবাসতেন, কিন্তু কারো কোনো সন্তান ছিলো না। ঋষি চন্দকৌশিক একবার তার কাছে এলেন এবং একটি মন্ত্র পড়া আম তাকে দিয়েছিলেন বর (আশির্বাদ) হিসেবে। যে আম তার স্ত্রীদের খাওয়ালে তারা সন্তান জন্ম দিতে পারবে। বৃহদ্রথ আমটি দুই ভাগ করে দুই স্ত্রীকে খাওয়ালেন। এর ফলে তার দুই স্ত্রী অর্ধেক বাচ্চার জন্ম দিলো। রাজা রেগে গিয়ে অর্ধাংশ দুইটি বনে ফেলে দিতে নির্দেশ দিলেন। সেই বনে জরা নামক এক রাক্ষসী বসবাস করতো। সে দুইটি অর্ধাংশ দেখতে পেল এবং অর্ধাংশ দুইটি যুক্ত করে একটি পূর্ণ বাচ্চা বানালো। জরা বাচ্চাটিকে রাজার কাছে নিয়ে গেলো এবং ফেরত দিয়ে দিলো। জরা বাচ্চাটির দুইটি অংশ জুড়ে দিয়েছিলো, তাই বাচ্চাটির নাম রাখা হলো জরাসন্ধ।
দুই অংশের সন্ধির ফলে তিনি প্রাণ পান এবং শক্তিশালী হন। কৃষ্ঞের পান পাতা চিরে দেখানো কৌশলে তাকে লম্বালম্বিভাবে চিরে দুর্বল করা হয় অর্থাৎ হত্যা করা হয়। তেমনি পান পাতার মাঝের মরুদণ্ডের মতো অংশকে লম্বালম্বিভাবে চিরলে পান পাতার গুণের অংশকে ভাগ করে ফেলা হয় কিংবা শক্তি ভাগ হয়ে যায় বলে মিথে মনে করা হয়। তাই পান পাতা লম্বালম্বিভাবে চিরে না ফেলার মিথ রয়েছে।
এছাড়াও সনাতন ধর্মে পান পাতার গুরুত্ব রয়েছে। সনাতন ধর্মে দেবীকে পান পাতা অর্পণ করা খুবই শুভ বলে মনে করা হয় এবং যে কোনো পূজায় এই পাতা ব্যবহারের প্রথা বহুকাল ধরে চলে আসছে। বিশেষ করে লক্ষ্মী, গণেশ এবং আরো অনেক ধরনের পূজায় পানের ব্যবহার জরুরি বলে মনে করা হয়। পানকে শুভ ও লাভের প্রতীক মনে করা হয়। এ কারণে পূজায় এটি অন্তর্ভুক্ত না হলে পূজা অসম্পূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। অনেক পৌরাণিক কাহিনী আছে যা পান পাতার গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দেয়।
পূজা-পাঠেরর সময় পান পাতার মধ্যে সুপারি ও অক্ষত (গোটা চাল) রাখা হয় এবং রীতি অনুযায়ী দেব-দেবীদের নিবেদন করা হয়। অনেক জায়গায়, পূজার সময়, পান পাতার সঙ্গে কর্পূর পোড়ানো হয়, যা বাড়িতে ইতিবাচক শক্তি নিয়ে আসে।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জ্যোতিষী পন্ডিত নারায়ণ হরির কাছ থেকে জেনে নেয়া যাক কেন পূজায় পান ব্যবহার করা হয় এবং এর বিশেষ তাৎপর্য কী?
পান পাতা এর তাজা এবং সুগন্ধি প্রকৃতির জন্য পরিচিত, যা যেকোনো পূজার অন্তর্ভুক্ত। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, এটি পবিত্রতার প্রতীক এবং এটি পূজা সম্পূর্ণ করে। পূজার সঙ্গে যুক্ত অনেক আচার-অনুষ্ঠানে পান পাতা দেওয়া দেব-দেবীর আশীর্বাদ পাওয়ার সমতুল্য। এই পাতার প্রাণবন্ত সবুজ রঙ জীবনের নতুন সূচনা এবং পুনর্জীবনের সঙ্গে জড়িত।
পান পাতা শুভ ও সমৃদ্ধির প্রতীক
পান পাতা শুভতা এবং সমৃদ্ধির আশীর্বাদ পেতে প্রায়ই পূজার ব্যবহার করা হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, পানের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য উপাসককে ইতিবাচক শক্তি এবং ঐশ্বরিক আশীর্বাদ আকর্ষণ করে। এটি উপাসনায় মনোনিবেশ করতে সহায়তা করে। হিন্দু ধর্মে পান পাতা কখনো কখনো পবিত্র ত্রিদেব-ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের প্রতিনিধিত্বকারী বলে মনে করা হয়। পূজার সময় পানের পাতা নিবেদন করা এই ঐশ্বরিক শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের একটি সহজ উপায় এবং উপাসক কর্তৃক মহাজাগতিক আদেশের স্বীকৃতির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ স্কন্দপুরাণে পানের উল্লেখ আছে। পূজায় পান ব্যবহার করার পিছনে সমুদ্র মন্থন সম্পর্কিত একটি গল্প উল্লেখ করা হয়েছে। এটা বিশ্বাস করা হয়, অমরত্বের অমৃত প্রাপ্তির জন্য দেবতা এবং অসুরদের সমুদ্র মন্থন থেকে ঐশ্বরিক বস্তুপ্রাপ্ত হয়েছিল, যার মধ্যে একটি ছিল পান।
মহাভারতের মতো মহাকাব্যেও এই পাতার উল্লেখ রয়েছে, যার কারণে এটিকে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অংশ করা বাধ্যতামূলক বলে মনে করা হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, পানের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন দেব-দেবীর অধিষ্ঠান রয়েছে, তাই পূজায় এটি নিবেদনের প্রয়োজন রয়েছে, যার ফলে মানুষ আশানুরূপ ফল পায়।