বর্তমান বিশ্বে মাদকাসক্তি আর লুকিয়ে রাখার কোনো বিষয় নয়। কেননা সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বজুড়ে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকের অপব্যবহার। সঙ্গে সঙ্গে আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে বিপণনের কলাকৌশল। বাড়ছে আসক্তজনিত ক্ষতির ভয়াবহতা। ধ্বংস হচ্ছে মাদকাসক্তের পরিবারের স্বপ্ন-স্বাধ এবং প্রত্যাশা। আমাদের অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মও হুমকির সম্মুখীন। মূলত মাদক এখন বিশ্বজনীন অভিশাপে রূপ নিয়েছে।
এ কথা কেন বললাম? যে তারুণ্য আপন বিভায় আলোকিত করবে সমাজ, দেশ আর বিশ্বকে। সেই অমিত সম্ভাবনাময় তরুণদের অনেকেই আজ নেশার মদিরে টালমাটাল। যে শিশু-কিশোররা আগামীর বাংলাদেশ তাদের মধ্যেও এর বিষাক্ত ছোবল থেমে নেই। বহু পরিবার আজ অসহায়। বহু অভিভাবক আজ নিরুপায়। এমন কী মাদকের বিভীষিকা মেয়েদের মাঝেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বাদ নেই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সেখানেও চলছে মাদকের কুটিল হাতছানি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত অস্থিরতা বিবেকবান যেকোনো বিদগ্ধ মানুষকে করছে আতঙ্কিত।
মাদক এখন শুধু একক অপরাধ নয়। মাদকাসক্তির সঙ্গে সন্ত্রাস এবং অন্যান্য অপরাধ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে দুর্দমনীয় অপরাধের মাত্রা। মাদকাসক্তির ভয়াবিহ্বল চিত্রের বিরূপ-বিরূপতা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এই মহাসংকট নিরসনে সম্মিলিত শক্তিতে মাদককে রুখে দেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে জাতিসংঘ ২৬ জুনকে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস ঘোষণা করেছে। প্রগতির পথে ধাবমান বাংলাদেশও অন্যসব দেশের মতো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে এ দিবস পালন করছে। ২০১৬ সালে জাতিসংঘ এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছিল, ‘Listen FIRST: Listening to children and youth is the first step to help them grow healthy and safe. অর্থাৎ ‘আগে শুনুন: শিশু ও যুবাদের প্রতি মনোযোগ দেয়াই তাদের নিরাপদ বেড়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ।’
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান স্যারের চমৎকার লেখাটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘শিশুরা হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। একটি শিশুর বেড়ে ওঠা যদি আপনি নিশ্চিত করতে পারেন তাহলে একজন সফল মানুষ, ভালো মানুষের গ্যারান্টিও আপনি পেতে পারেন।’ অর্থাৎ সফল মানুষ, ভালো মানুষের গ্যারান্টি পেতে হলে শিশু-যুবাদের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে। সুতরাং স্যারের লেখার মূলকথা অনুধাবনেও মনোযোগ প্রসঙ্গটিই চলে আসে।
সম্প্রতি সমাজে চলছে পরস্পর লাগামহীন প্রতিযোগিতা। তাই ইচ্ছে থাকলেও মা-বাবারাও সন্তানদের প্রতি কোয়ালিটি সময় দিতে পারছে না। ভাবছে, পড়াশোনা করাতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত অর্থ। তাই অর্থ উপার্জনের জন্য উভয়কেই তীব্র প্রতিযোগিতায় দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। এমনকি সন্তানদেরকেও উৎসাহিত করছে প্রতিযোগিতার দিকে ধাবিত হতে। তাই কারো সঙ্গে কারো সত্যিকারের যোগাযোগটা আর হচ্ছে না। সম্প্রতি আমাদের পরিবারগুলো হয়ে পড়েছে এমনই বিচ্ছিন্নতাবোধের নির্মম শিকার। মূলত রোজগারে বাবা ব্যস্ত। গৃহিণী মা ব্যস্ত টিভি সিরিয়াল বা পরচর্চায়। এক্ষেত্রেও যোগাযোগে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। একদিন হয় তো আবিষ্কার করে পুত্ররত্নটি নেশায় আসক্ত। আর কন্যারত্নটি বখাটে ছেলের গলায় ঝুলে পড়েছে। তারা ভাবছে, সন্তানদের জন্যই তো দিন-রাত এতটা খাটা-খাটুনি। অনেকেই অবশ্য বলে থাকেন যখন যা প্রয়োজন দিয়েছি। টাকা-পয়সার চাহিদা পূরণ করেছি। কিন্তু আসল কাজটিই করা হয়নি। সেটা হলো মনোযোগ। আর মনোযোগের অভাবেই মূলত সন্তানরা পথভ্রষ্ট হচ্ছে। এতে স্বামী-স্ত্রীতে শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি। শুরু হয় সন্তানদের অধপতনের জন্য পরস্পর দোষারোপের সংস্কৃতি। এর মূল কারণও যোগাযোগের অভাব। এক্ষেত্রে যোগাযোগটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ফেসবুকের যোগাযোগ নয়, মোবাইলেও যোগাযোগ নয়। দরকার সামাজিক যোগাযোগ, প্রত্যক্ষ মানবিক যোগাযোগ। যেমন এক টেবিলে বসে খাওয়া-দাওয়া। সন্তানদের পাতে মাছের মুড়োটি তুলে দেওয়া। ফাঁকে ফাঁকে পড়াশুনা, অসুখ-বিসুখ বা আনুষঙ্গিক খোঁজখবর নেয়া। আন্তরিক পরিবেশে কার কী সমস্যা তা জানা। প্রয়োজনে আলোচনায় তা সমাধান করা। তাছাড়া একসঙ্গে খাবার পরিবেশনে তৈরি হচ্ছে ভালোবাসার স্নেহনিলয়। বেড়েছে যোগাযোগ। গড়ে ওঠছে পারস্পারিক সৌহার্দ ও একাত্মতা।
তবে এটাও সত্য মনোযোগায়নকে ধরে রাখা চাই। তাই মনোযোগ হরণকারী বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যকীয়। নতুবা এগুলো আমাদের পারিবারিক বন্ধনকে ঢিলেঢালা করে দেয়। তাই অতিরিক্ত টিভি, সিরিয়াল, ফেসবুক, ইন্টারনেট ইত্যাদির প্রতি আসক্তি কমাতে হবে। কারণ, প্রযুক্তিপণ্যগুলো এতটাই আসক্তিপ্রবণ যে, তা মাদকের মতোই নানাভাবে প্রাণসংহারী হয়ে ওঠতে পারে। তাই জীবনে ভালো কিছু অর্জন করতে হলে অতিরিক্ত খারাপ কিছু তো বর্জন করতেই হবে। সন্তানকে মানুষ করতে হলে আগে নিজে মানুষ হতে হবে। নতুবা সন্তানকে সদুপদেশ দিলেও কাজের কাজ কিছুই হবে না।
পারিবারিক সুখ-সমৃদ্ধি মূলত সন্তানদেরকে ঘিরেই তো আবর্তিত হয়। তাহলে আসুন, মাদকমুক্ত সুখীসমৃদ্ধ পরিবার গড়ায় আমরা মনোযোগায়নের প্রতি মনোযোগী হই। পরিবারে মনোযোগের আবহ সৃষ্টি করি। এতে সবার প্রতি সবার গুরুত্ব বাড়বে। তৈরি হবে মনোযোগায়ন। ফলে পরিবারকে একটি আদর্শ সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হবে। রচিত হবে পরিবার নামক সুখ-দুঃখের এক মহাকাব্য। তৈরি হবে সুখের নীড় নামক আমাদের ভেতরকার এই ক্ষুদ্র পৃথিবী। সুতরাং এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভেতরকার পৃথিবী নিয়েই তো আমাদের বৃহৎ পরিসরের পৃথিবী। তা হলেই পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা মোকাবেলায় আমরা সফল হবো। মাদক নামক দুষ্টু গ্রহের দৃষ্টি থেকেও সন্তানকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হবো।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ-প্রতিবেদনের বিষয় ছিল, ‘দি মাইন্ডফুল রেভুল্যুশন- মনোযোগায়নের বিপ্লব।’ এর মূল কথা একটাই, ‘যে কাজই করি না কেন দিতে হবে পূর্ণ মনোযোগ।’ সুতরাং সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তোলার চেয়ে মহৎ কাজ আর নেই। আসুন, মনোযোগায়নের বিপ্লব ঘটাই। নেশার ঝিমুনিতে পথহারা সমাজকে আলোকিত পথের দিশা দেই। সন্তানদের মানুষ করে গড়ে তুলি। আর মাদকমুক্ত একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দেই।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক