ঢাকা সোমবার, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

Rupalibank

দালাল ও রাইটারদের প্রাধান্য


স্মার্ট ডেক্স
৪:১৭ - সোমবার, অক্টোবর ৭, ২০২৪
দালাল ও রাইটারদের প্রাধান্য

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দেশের অধিকাংশ থানা অনেকটা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। অনেক থানা হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের কবলে পড়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মনোবল হারিয়ে ফেলে পুলিশ। অন্তর্বর্তী সরকার ও পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কাজে যোগ দিতে বললেও ‘ভয়ে’ অনেকে নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে যোগ দেয়নি। সরকারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে বেশির ভাগ পুলিশই কাজে ফিরছে। সুত্র: ভোরের কাগজ

তবে ‘ট্রমা’ কাটেনি তাদের। থানার কার্যক্রম এখনো স্বাভাবিক হয়নি। এরমধ্যে একশ্রেণির দালাল ও রাইটারের দৌরাত্ম্য চরমে পৌঁছেছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে থানা-পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থানার ওসিসহ অন্য পরিদর্শকদের কক্ষে দালাল ও টাউট-বাটপাড়দের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। নতুন কর্মস্থলে পরিস্থিতি এখনো বুঝে উঠতে না পেরে মুখ বুজে সব সহ্য করছে পুলিশ। পুলিশের এমন নীরবতায় জনজীবনে শঙ্কা কাটিয়ে স্বস্তি ফেরেনি।

এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, থানায় রাইটার বলে কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক মানুষ নিরক্ষর এবং সেবাপ্রত্যাশীরা অনেক বিষয়ে অজ্ঞ হওয়ায় তাদের জন্য রাইটারের সহযোগিতা নেয়া হয়। কিন্তু এজাহারের ক্ষেত্রে এভাবে রাইটার দিয়ে লেখানো বর্ণনা গ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। নির্দেশনা দেয়া হয়, বাদী যা বলবেন- ততটুকুই এজাহারে উল্লেখ করার। লিখিত বর্ণনা দিলে সেখানে রঞ্জিত বর্ণনা থাকার সুযোগ থাকে। সাধারণ ডায়েরি দায়েরের ক্ষেত্রেও থানা-পুলিশকেই সহযোগিতা করার নির্দেশনা থাকে। এর বাইরে গিয়ে কোনো রাইটার বা দালাল যদি কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ করে তাহলে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাদের ওই দালালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

জানা গেছে, সারাদেশে ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৮ মেট্রোপলিটনে ১১০টি ও রেঞ্জে ৫২৯ থানা রয়েছে। এরমধ্যে সাড়ে ৪শরও বেশি থানা গত ৫ আগস্ট আক্রান্ত হয়। আলামত, মালখানা ও অস্ত্রাগার লুট হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য, আহত হয়েছে সহস্রাধিক । এ অবস্থায় সরকার বদল হলেও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে পুলিশ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় পড়েন অনেক কর্মকর্তা ও সদস্য। বাহিনীর পোশাক পরে রাস্তায় বের হতে সাহস হারায় তারা। বন্ধ হয়ে যায় টহল, অভিযানসহ সব কার্যক্রম। আর পুলিশের অনুপস্থিতিতে জনজীবনে আতঙ্ক বিরাজ করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। এরমধ্যে সশস্ত্র বাহিনী মাঠে নেমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে দুই মাসের জন্য চলছে যৌথ অভিযান। কিন্তু জনমনে এখনো স্বস্তি ফেরেনি।

এদিকে আন্দোলন চলাকালে রাজধানীসহ দেশের যেসব থানা এলাকায় সংঘাত ও সহিংসতা হয়েছে সেসব থানায় ৫ আগস্টের পর থেকে দালালদের আনাগোনা বেড়েছে। পুলিশে ব্যাপক রদবদলের কারণে থানার কর্মকর্তাদের কাছে কর্মস্থলের সবই নতুন। তারা এখনো কোনোকিছু বুঝে উঠতে পারছে না। এই সুযোগে একশ্রেণির দালাল ও টাউট-বাটপাড় থানায় গিয়ে নিজেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, কেউ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক; আবার কেউ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিজেকে নির্যাতিত দাবি করে থানায় সময় পার করছে। তাদের কারণে ব্যাহত হচ্ছে পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম। এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘রাইটার’।

তারা নানা অজুহাতে থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কক্ষসহ ওসি (অপারেশন), ওসি (তদন্ত) এমনকি ডিউটি অফিসারের কক্ষে সময় কাটাচ্ছে তারা। চলমান ইস্যুতে তারা বিভিন্ন অভিযোগে এজাহারে লোকজনের নাম দিচ্ছে, বাদ দিচ্ছে। আর হয়রানিমূলক মামলায় নাম দেয়া ও বাদ দেয়ার কথা বলে দরকষাকষি করে ‘বাণিজ্য’ চলছে প্রকাশ্যে। বাদী সাজিয়ে বা হতাহতদের স্বজনদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ডেকে এনে মামলা সাজানো হচ্ছে। বিষয়টি এখন ওপেনসিক্রেট। মামলা সাজিয়ে হয়রানির অভিযোগে বেশ কয়েকজন এরই মধ্যে আটকও হয়েছে।

তবুও কমছে না দালাল ও রাইটারদের দৌরাত্ম্য। তারা বিভিন্নজনকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বা সমর্থক প্রচার করে পুলিশ দিয়ে আটক বা ছাড়ানোর কারবার করছে আগের মতোই। অনেকে অভিযোগ লিখে থানায় জমা না দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দিয়ে সেখানে উল্লেখিত বিবাদীদের কাছ থেকে টাকা হাতাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে মামলা হলেও তদন্ত ছাড়া কাউকে আটক না করতে নির্দেশনা দিলেও তা অগ্রাহ্য করছে অনেক থানা-পুলিশ। আর পুরনো কায়দায় মামলা বাণিজ্য চলছে পুরোদমে। নিহতের ঘটনায় গণআসামি দিয়ে মামলা বাণিজ্যের পর এখন আহতদের দিয়ে মামলা করিয়ে সেখানে মনমতো আসামি দিচ্ছে একাধিক চক্র। অনেক মামলার বাদী এরইমধ্যে কয়েকজন আসামির ব্যাপারে আদালত ও থানায় লিখিতভাবে অনাপত্তি দিয়েছেন। এ নিয়ে থানা-পুলিশ ও তদন্ত কর্মকর্তা পড়েছেন বিপাকে। আবার মামলা থেকে নাম বাদ দিতে ক্ষতিগ্রস্ত থানা সংস্কার, এসি, ফার্নিচার ও টাইলস কেনার কথা বলে একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে অনেক থানার পুলিশের বিরুদ্ধে। রেঞ্জ ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের তদারকিতে ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র।

একাধিক থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ধ্যার পর থেকে থানায় থানায় দালালদের আনাগোনা বাড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত তারা থানা ও আশপাশ এলাকায় অবস্থান করে। তারা নানাভাবে নিজেদের উপস্থাপন করে ওসির সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে কোনো কিছু বুঝে উঠতে না পেরে পুলিশ যেন অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে। আবার অনেক থানায় ছাত্র ও সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে একদল নানাবিধ অভিযোগ নিয়ে পুলিশে চাপ প্রয়োগ করছে। মূলত এদের কারণেই থানায় গায়েবি মামলা ও গণহারে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এই চক্রের তৎপরতার কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হেডকোয়ার্টার্স থেকে বারবার নির্দেশনা দেয়ার পরও পুরোদমে স্বাভাবিক ও পেশাদার কার্যক্রমে ফিরতে পারছে না থানা-পুলিশ। থানা লুট ও পুলিশ হতাহতের অধিকাংশ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। জড়িতদের ধরতে নেই কোনো অভিযান।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আওয়ামী লীগ সরকার পতন আন্দোলন ৫ আগস্ট দুপুরে চূড়ান্ত রূপ নিলে দেশের অনেক থানা আক্রান্ত হয়। রাজধানীর ৫০টি থানার মধ্যে যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, ভাটারা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, খিলগাঁও, কদমতলী, উত্তরা পূর্ব, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, লালবাগসহ বিভিন্ন থানায় রাতভর হামলা এবং লুটপাটের ঘটনা ঘটে। মুন্সীগঞ্জ জেলার ছয়টি থানা; গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও জয়দেবপুর থানাসহ সাতটি পুলিশ ফাঁড়ি; ঢাকা জেলার সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানা; নরসিংদী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, সিলেট, চাঁদপুর, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, দিনাজপুর, জয়পুরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলার থানায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

এরমধ্যে সংঘর্ষ ও গুলিতে যেসব থানা এলাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে- সেসব থানায় মামলা রুজু করা হচ্ছে। যার অধিকাংশ ঘটনায় বাদী জানেন না বিবাদী বা আসামির নাম। অনেক মামলায় অভিযোগ লেখার আগেই বাদীর স্বাক্ষর বা টিপসই নেয়া হয়েছে। এতে একাধিক চক্র ইচ্ছেমতো আসামির নাম বসিয়েছে। এজাহারের মনগড়া নাম উল্লেখ ছাড়াও লেখা হচ্ছে শত শত বা কয়েক হাজার অজ্ঞাত আসামি। যাতে মামলার তদন্ত ও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে, দালাল ও রাইটারদের কারসাজিতে গায়েবি মামলা বেড়েছে। আসামির তালিকায় ঢালাও নাম দেয়া হয়েছে; যার অধিকাংশই আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। আবার অনেক মামলায় আসামির তালিকায় আছে মৃত ব্যক্তির নামও। এদের কারণে পুলিশের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। বেগতিক পরিস্থিতিতে পুলিশ কাউকে কিছু বলতে পারছে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ পুলিশের এখন অন্যতম একটি কাজ হচ্ছে রিফর্ম। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন জেলা, রেঞ্জ ও থানার কর্মকর্তাদের বদলি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন সবাই। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সবাইকেই নির্দেশনা দেয়া রয়েছে আইনের ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। যে কোনো অনৈতিক কাজকে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না। সেক্ষেত্রে রাইটার বা দালালের দৌরাত্ম্য দেখা দিলে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থায় যাবেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।