ছোট্ট চায়ের দোকান, বিক্রি করেন ভাতও। রমজান আসতেই রাত ২টা থেকে ওই দোকানে নানা আয়োজনে চলছিল হরেক রকমের রান্না। দেখলে মনে হবে কোন না কোন আড়ম্বর অনুষ্ঠান চলছে। কিন্তু দোকানে নেই কোন কাস্টমার, মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সেহরী খাওয়ার ডাক আসতেই দেখা মেলে ছিন্নমূল, অসহায়, গরীব রোজাদারদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ দোকানটি। এরপরই গরু-মুরগির মাংস, মাছ, সবজিসহ নানা পদের তরকারিতে সেহেরী খেতে ব্যস্ত রোজাদাররা। খাওয়া শেষে টিস্যু-মসলা দিয়ে ভালো আপ্যায়ন পেলেও কাউকে বিল পরিশোধ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু কেন? কে এই উদ্যোক্তা, কিভাবে চলছে তাঁর এই আয়োজন?
জানা গেছে, নোয়াখালী জেলা শহরের পূর্ব লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা
মো. মঞ্জু। স্থানীয় বসিরার দোকানে ছোট্ট চায়ের দোকান চালিয়ে করেন জীবিকা
নির্বাহ। ২০২০ সালের করোনা মহামারির সময় মানুষ যখন কর্মহীন হয়ে খাদ্যের
অভাবে ভুগছিলেন, ঠিক সেই সময় পবিত্র মাহে রমজানে বিবেকের তাড়নায় রোজাদারদের
জন্য তাঁর দোকানে নিজ উদ্যোগে মাস ব্যাপী বিনামূল্যের সেহেরীর উদ্যোগ নেয়
মঞ্জু। সেই থেকে গত পাঁচ বছর রমজান মাসজুড়ে মঞ্জুর দোকানে চলে এই
বিনামূল্যের সেহেরীর আয়োজন। রাত ২টা থেকে শুরু হয় রোজাদারদের জন্য সেহেরী
রান্না। রান্না শেষেই মুয়াজ্জিনের ডাকের সঙ্গে তালমিলিয়ে রাত সাড়ে ৩টা থেকে
মঞ্জুও ডাকতে থাকেন- সেহেরীর সময় হইছে, আসেন, সেহেরী খেয়ে যান। আসেন
আপনারা (রোজাদার) আল্লাহর মেহমান, সেহেরী খেয়ে যান। এরপরই ছিন্নমূল, অসহায়,
গরীব রোজাদারদের উপস্থিতিতে মঞ্জুর দোকান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়।
পরে সেহেরীর শেষ সময় পর্যন্ত চলে রোজাদার মেহমানদের আপ্যায়ন।
মঞ্জুর
বিনামূল্যের এই সেহেরী খেয়ে বেজায় খুশি রোজাদাররাও। কথা হয় সেহেরী খেতে আসা
রোজাদার আমিনুল ইসলাম, গিয়াস উদ্দিন, আতরেজ্জামানের সঙ্গে। তাঁরা বলেন,
আমাদের মতো গরীব, অসহায় মানুষকে বিনা টাকায় সেহেরী খাওয়ান মঞ্জু মিয়া।
তিনিও গরীব মানুষ। তারপরও তিনি তাঁর আয়ের একটি অংশ জমা করে প্রতি রমজানে
আমাদেরকে বিনা টাকায় সেহেরী খাওয়ান। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতি রাতে
সেহেরী খেতে আসেন আমাদের মতো রোজাদারগন। আমরা যেন টাকা ছাড়া সেহেরী খেতে
লজ্জা না পাই, সেইজন্য মঞ্জু আমাদেরকে আল্লাহর মেহমান ডাকেন। তিনি আল্লাহর
এই মেহমানদের গত পাঁচ বছর বিনামূল্যে সেহেরীর মাধ্যমে আপ্যায়ন করে আসছেন।
বর্তমানে মঞ্জুর বিনামূল্যের সেহেরীতে প্রতিদিন অংশ নিচ্ছেন ৪০ থেকে ৬০জন
রোজাদার।
মঞ্জুর এমন মহতি উদ্যোগের জন্য স্থানীয়রাও তাকে দিচ্ছেন বাহ্
বাহ। স্থানীয় বাসিন্দা মো. খসরু, নিজাম উদ্দিন, আনোয়ার হোসেন বলেন, সমাজে
অনেক বিত্তবান মানুষ আছেন, কিন্তু মঞ্জুর মতো মন তাদের অনেকেরই নাই।
সামান্য আয়-রোজগার করে যেখানে তাঁর সংসার চালাতে কষ্ট হয়, সেখানে গত ৫ বছর
ধরে প্রতি রমজানে নিজ উদ্যোগে ছিন্নমূল, গরীব, অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে
সেহেরী খাওয়াচ্ছেন । এটি একটি মহৎ ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সমাজের বিত্তবান
মানুষদের আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে মঞ্জুর মতো মানবিক উদ্যোক্তাদের পাশে
দাঁড়ানো উচিৎ বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
ইতিমধ্যে মঞ্জুর মহৎ উদ্যোগে খুশি
হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন আমেরিকা প্রবাসী মনির আহমেদ ও তাঁর পরিবারের
সদস্যসহ স্থানীয় বেশ কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তি। পৃষ্টপোষক আমেরিকা প্রবাসী
মনির আহমেদ বলেন, মঞ্জু একজন ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী হয়েও বড় ধরণের মানবিক
উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যার কারণে নোয়াখালী শহরজুড়ে প্রশংসায় ভাসছেন চায়ের
দোকানী মো. মঞ্জু। মঞ্জুর মানবিক উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা তাঁর পাশে
দাঁড়িয়েছি। আমরা চাই, মঞ্জু যতদিন বাঁচবে এমন উদ্যোগকে আরো প্রসারিত করে
চালিয়ে যাবেন।
সেহরি খাওয়াতে পারাটা সৌভাগ্যের মনে করছেন চায়ের দোকানী
মো. মঞ্জু। তিনি অত্যন্ত খুশি। করোনার সময় থেকে গত পাঁচ বছর নিজের আয় থেকে
কিছু টাকা সঞ্চয় করে বিনামূল্যে সেহরীর এমন আয়োজন করেন বলে জানান মঞ্জু।
আজীবন এই আয়োজনে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার আশা প্রকাশ করে মঞ্জু বলেন,
বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে এই আয়োজনের পরিধি আরো বাড়াতে পারবো।
মঞ্জু যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন তা প্রশংসনীয়। এটি একটি মহৎ কাজ। তাঁকে দেখে অন্যরাও এমন মানবিক কাজে এগিয়ে আসবেন, এমনটাই প্রত্যাশা করেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আখিনূর জাহান নীলা।