সাত বছর আগে জন্ম নেয়া মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের জনবল নিয়োগ নিয়ে প্রশাসন ও শিক্ষা ক্যাডারের মধ্যে ভীষণ ‘ঠেলাঠেলি’ শুরু হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষমতার সামনে টিকতে না পেরে শিক্ষা ক্যাডার উচ্চ আদালতে গিয়েছে।
উচ্চ আদালতের আদেশ শিক্ষা ক্যাডারের পক্ষে গেলেও কোনো লাভ হয়নি। বরং প্রশাসন ক্যাডারের চাপে মাদ্রাসা অধিদপ্তর থেকে দুদফায় শিক্ষা ক্যাডারের ১৯ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রথম দফায় ১৪ জনকে প্রত্যাহার করতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ এবং দ্বিতীয় দফায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ মাদ্রাসা অধিদপ্তর থেকে ৫ জনকে প্রত্যাহার করে নেয়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেছেন- প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাদ্রাসা অধিদপ্তরে বসেছেন। অপরদিকে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা ওখানে প্রেষণে পদায়ন পেতে পারতেন। কিন্তু প্রেষণকে নিজেদের বলে দাবি করা যায় না। এমন কথার উত্তরে শিক্ষা ক্যাডারের নেতারা বলেছেন, যে কোনো মূল্যে আমলারা মাদ্রাসা অধিদপ্তরের পদগুলো নিজেদের অধীনে নিতে চান। এ কারণেই শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সরে যেতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে বিভিন্ন পদে শিক্ষা ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডার কিংবা সরাসরি নিয়োগের বিরুদ্ধে গত বছর উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করে শিক্ষা ক্যাডার। সেই রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পদগুলোতে সরাসরি নিয়োগ অথবা শিক্ষা ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডার থেকে প্রেষণে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেন। কিন্তু প্রশাসন সেই আদেশ মানছে না।
জানতে চাইলে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারদের সংগঠন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিচ্ছে। এর আগে এ বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রশাসনে একটি চিঠিও দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না।
তবে এর বিপরীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের যুগ্ম সচিব (মাদ্রাসা অনুবিভাগ) শাহনওয়াজ দিলরুবা খান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু পদের অভাবে তারা যোগদান করতে পারছিলেন না। পরে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সরিয়ে তাদের যোগদান করানো হয়।
তিনি বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা সেখানে প্রেষণে ছিলেন। প্রেষণে থাকলে নিজের বলে ধরে নেয়া যায় না। আর মাদ্রাসা অধিদপ্তরের পদগুলো শিক্ষা ক্যাডারের জন্য রাখা হয়েছে- যারা এমন কথা বলছেন তারা কোথা থেকে এই তথ্য পেয়েছেন জানি না। তার মতে, অধিদপ্তরের শুরু থেকে এখানে প্রশাসন ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তারাই ছিলেন। এখন কীভাবে শিক্ষা ক্যাডার দাবি করে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। এছাড়া মহাপরিচালকের পদটি প্রশাসনিক পদ। এখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগ পাবেন এটাই স্বাভাবিক।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মাদ্রাসা অধিদপ্তরের শুরু থেকেই এর পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডার এবং নন-ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বসানোর জন্য গোপনে একটি নিয়োগবিধি করা হয়েছে। এই নিয়োগবিধি করার সময় প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন অংশীজনদের মতামতও নেয়নি। এর ফলে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগবিধিতে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়নের সুযোগ রহিত করে প্রশাসন ক্যাডারের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের আপত্তির মুখে গোপনে এ নিয়োগবিধি প্রণয়ন করেছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। ইতোপূর্বে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দখল করেছে প্রশাসন ক্যাডার। এভাবে শিক্ষার সব প্রশাসনিক পদ দখলের দিকে এগোচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার।
এমন আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির আইনসচিব অধ্যাপক দেলোয়ার আহমেদ বলেন, সরকার কিংবা আমলারা যখন যা ইচ্ছা প্রকাশ করে তখনই তা বাস্তবায়ন করে। এ অবস্থায় শিক্ষা ক্যাডার পেরে উঠবে না। তবু শিক্ষা ক্যাডার উচ্চ আদালতে গিয়েছে। আমরা আদালতের রায়ের ওপর নির্ভরশীল। আদালত নিশ্চয়ই কাউকে ঠকাবে না।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত সাত বছর ধরেই মামলা ঠেলে যাচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর। ২০১৬ সালে অধিদপ্তরটি স্থাপনের পর নিয়োগবিধিতে বলা হয়, নবম গ্রেডের উপরে যারা আছেন তারা এখানে পদায়ন পাবেন। কিন্তু শুরুতেই মহাপরিচালক পদে একজন যুগ্মসচিবকে পদায়ন করা হলো। এরপর এই পদকে অতিরিক্ত সচিবে উন্নীত করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা ক্যাডার আদালতে যায়।
আদালত রায়ে জানায়, বিষয়টি ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষা ক্যাডারের বাইরে কাউকে পদায়ন দেয়া যাবে না, অর্থাৎ নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। আদালতের এমন রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার চেম্বার আদালতে গেল এবং নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকল। তারপর সরকার আপিল আদালতে গেল। সেখানে নিষেধাজ্ঞা উঠে যায় এবং মামলাটি নিয়মিত বেঞ্চে পাঠানো হয়। এই সুযোগে প্রশাসন প্রথম দফায় শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ কর্মকর্তাকে মাদ্রাসা অধিদপ্তর থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। পরে নিয়মিত বেঞ্চে মামলার শুনানি হলে আবারো নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কিন্তু তা না মেনেই গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ মাদ্রাসা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষা ক্যাডারের ৫ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নেয়। প্রত্যাহার আদেশ বাতিল করার জন্য বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি শিক্ষা প্রশাসনে চিঠি দিলেও এখনো আদেশ পরিবর্তন হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা ক্যাডারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় শিক্ষা সচিব ছিলেন শহীদুল ইসলাম। তার সময় থেকেই শিক্ষা দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তরে আমলাদের পদায়ন শুরু হয়। গত ১৯ বছরে শিক্ষায় আমলাদের দাপট ক্রমশ বাড়ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পুরোটাই আমলারা নিয়েছেন। শিক্ষার বিভিন্ন কমিটির প্রধান পদে আমলারা বসে গেছেন। সর্বশেষ মাদ্রাসা অধিদপ্তর আমলারা প্রায় নিয়েই নিয়েছেন। এখন বাকি শিক্ষার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। আমলারা এটা নেয়ার জন্যও নানা ফন্দিফিকির শুরু করেছে। হয়তো একদিন মাউশির মহাপরিচালক হয়ে যাবেন একজন অতিরিক্ত সচিব। অর্থাৎ শিক্ষার পদগুলো নিজের অধীনে নিতে আমলারা ‘থাবা’ দিচ্ছেন। কারণ প্রশাসন ক্যাডারে বহু কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়ে নিচের পদেই কাজ করে যাচ্ছেন। এখন বিভিন্ন দপ্তরে পদ দখলে নিতে পারলে তাদের পদায়ন করা যাবে।