১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে নিজের পিস্তল তুলে দিয়ে যখন আত্মসমর্পণ করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। সেদিন ঢাকার রাস্তায় নেমে এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। একের পর এক আনন্দ মিছিলে মুখরিত হয়ে উঠেছিল অলিগলি-রাজপথ।
কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই আরেকটি ঘটনা সামনে আসে, যা জাতির বিজয়ের আনন্দকে রীতিমত বিষাদে পরিণত করে দিয়েছিল। বিজয়ের পরের দিন জানা যায়, আত্মসমপর্ণের আগে পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ শত শত বাঙালি বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে বের হতে থাকে একের পর নিহত বুদ্ধিজীবীর মরদেহ শনাক্তের খবর। ঘটনাটিকে ‘মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’ বলে বর্ণনা করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক।
অন্যদিকে, ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’ শিরোনামে খবর ছেপে দৈনিক পূর্বদেশ লিখেছিল, ‘স্রোতস্বিনী পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি আমাদের প্রিয়জনদের রক্তে লাল হয়ে গেছে। একদিকে স্বাধীনতার আনন্দ, অন্যদিকে লাখো মানুষের আত্মহুতি।’
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্যানুসারে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সবমিলিয়ে সারাদেশে এগারো শ' জনের বেশি বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় দেড়শ জনই হত্যার শিকার হয়েছিল ঢাকায়, যাদের বেশিরভাগেরই মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।
কিন্তু তখন কীভাবে ওই বধ্যভূমির খবর সামনে এসেছিল? প্রথমদিকে কাদের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল? সেগুলোর অবস্থা কেমন ছিল? বুদ্ধিজীবী হত্যার খবরে বাংলাদেশ সরকারেরই-বা কী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল? সেইসময় প্রকাশিত পত্র-পত্রিকায় সংবাদ থেকে সেই তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
মরদেহের খোঁজ মিলেছিল যেভাবে-
যুদ্ধ জিতে বাংলার মানুষ যখন বিজয়োল্লাস করছিল, তখন ঢাকার রায়েরবাজারে জনশূন্য একটি নিচু এলাকায় শতাধিক মানুষের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন আশেপাশের বাসিন্দারা। তবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওইসব মরদেহের মধ্যে যে বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহও রয়েছে, সেটি অবশ্য প্রথমদিকে কেউ ধারণা করতে পারেননি বলে সেসময় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে।
১৯শে ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, শুক্রবার (১৭ই ডিসেম্বর) অপরাহ্নে ঢাকার কতিপয় সাংবাদিক কোনো এক সূত্রে আভাস পাইয়া এই বধ্যভূমিতে গিয়া ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের আলামত দেখিতে পান।
খবর পেয়ে ১৭ই ডিসেম্বর বিকেলে স্থানীয় গণমাধ্যমের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে যান। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে উৎসুক মানুষের ভিড়ও। প্রাথমিকভাবে তারাই কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর মরদেহ খুঁজে পান বলে তখনকার সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়। এরপর নিহত বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের খবর দেয়া হলে তারা ঘটনাস্থলে যান এবং স্বজনের মরদেহ শনাক্ত করেন।
এদিকে, নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ পাওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার পর ১৭ই ডিসেম্বর ভোরে থেকে বিদেশি গণমাধ্যমের কর্মীরাও রায়েরবাজারে উপস্থিত হতে শুরু করেন।
প্রথমদিকে যাদের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল-
১৭ই ডিসেম্বর রায়েরবাজারে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর মরদেহ শনাক্ত হওয়ার পরেরদিন ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল 'সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড'। আট কলামব্যাপি এই খবরটিতে বলা হয়েছিল, ১৭ই ডিসেম্বর বিকেলে রায়েরবাজারে বধ্যভূমিতে তিনজন বুদ্ধিবীজীর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তারা হলেন, তৎকালীন সময়ের স্বনামধন্য গণিতজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী। রায়েরবাজারে বধ্যভূমির একটি গর্তে তাদের মৃতদেহ একইসঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮ই ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ একই এলাকা থেকে আরো কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর মরদেহ উদ্ধার হয়, যাদের মধ্যে ডা. এএফএম আবদুল আলীম চৌধুরীর মৃতদেহও ছিলেন।
এ ঘটনার বেশ কয়েকদিন আগে তাদের সবাইকে অপহরণ করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা। একইভাবে আরো অনেক শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও চিকিৎসককে তুলে নেয়া হয়েছিল, যাদের খোঁজ তখনো পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় যেহেতু বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, সেই ধারণা থেকে দৈনিক ইত্তেফাক সেদিন লিখেছিল, অপহরণের শিকার ঢাকার শতাধিক বুদ্ধিজীবীর প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।
মরদেহের যে অবস্থা দেখা গিয়েছিল-
দেশ স্বাধীনের পরপরই রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের মরদেহ যে অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, সেটিকে এক কথায় বীভৎস বলে বর্ণনা করেছে তখনকার সংবাদপত্রগুলো।
১৯৭১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার খবরে বলা হয়, ফেরাউনের আমল হইতে হিটলারের গ্যাস চেম্বার পর্যন্ত বহু অমানুষিক ও লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী আমরা শুনেছি। কিন্তু সোনার বাংলায় এই সোনার সন্তানদের হত্যাকাণ্ড বিশ্বের সকল জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডকে ম্লান করিয়া দিয়াছে।
এর আগেরদিনের খবরে রায়েরবাজারে সন্ধান মেলা বুদ্ধিজীবীদের মরদেহগুলোর একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়, জনমানবহীন ওই এলাকার বিভিন্ন খানা-খন্দ, ইটের গাদা ও কিছুর গর্তের ভেতরে অপহরণের শিকার বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। ইতিহাসের এই জঘন্যতম নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শিকার বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহের সবগুলোই পেছনে হাত বাঁধা এবং বুক ও মাথায় গুলি ও বেয়োনেটের আঘাতের চিহ্ন। অনেকগুলোর চোখ উপড়ানো, ১৮শে ডিসেম্বর প্রকাশিত ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়।
খবরটিতে উল্লেখ করা হয়, বেশ কয়েকদিন পড়ে থেকে মরদেহের অনেকগুলো পঁচে দুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। বেশ কয়েকটির শরীরের হাড় ও কংকাল পর্যন্ত বের হয়ে গিয়েছিল। অনেকগুলো মৃতদেহ শকুন, শৃগাল, কাক ও কুকুরের আহার্যে পরিণত হইয়াছে। অনেকগুলোর শুধু কংকাল ছড়াইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। সমগ্র এলাকা পুঁতিগন্ধে বিষাক্ত।
সবমিলিয়ে অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল, কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে মরদেহগুলো দেখে স্বাভাবিক থাকা সম্ভব ছিল না বলে খবর থেকে জানা যাচ্ছে। বধ্যভূমির বীভৎস দৃশ্য দেখিয়া অনেকেই সেখানে মূর্ছিত হইয়া পড়েন, ১৯শে ডিসেম্বরের ইত্তেফাক পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
বিকৃত হয়ে যাওয়ায় অনেকের স্বজনরাও মরদেহ শনাক্ত করতে পারছিলেন না। ২০শে ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক বাংলার খবরে উল্লেখ করা হয়, এদের শোকাভিভূত আত্মীয়-স্বজন জামাতের সৃষ্ট এই বধ্যভূমিতে পাগলের মতো এদের লাশ খুঁজে ফিরছে। কিন্তু এই বধ্যভূমিতে যে শত শত লাশ গলে-পঁচে যাচ্ছে, সেগুলো আর শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই....যে লাশটি অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর বলে মনে করা হয়েছিল, পরে জানা যায় তা তার লাশ নয়।
এমন পরিস্থিতিতে স্বজনদের অনেকেই তখন মরদেহ শনাক্ত করেছিলেন মৃতের পরনের কাপড়, জুতা ইত্যাদি দেখে। তবে এমন অনেক মরদেহও ছিল, বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে যাদের পরিচয় পরবর্তীতে আর কখনোই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
সরকার যা বলেছিল-
রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে একের পর এক বুদ্ধিজীবীর মরদেহ খুঁজে পাওয়ার ঘটনায় ২০শে ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায় স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী সরকার।
আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের কয়েকশ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে বলে মুজিবনগর সরকারের বরাত দিয়ে পরের দিন খবর প্রকাশ করে জাতীয় দৈনিকগুলো।
সেখানে বলা হয়, বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। আর এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিল জামাতে ইসলামীর আল বদর বাহিনী। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আরো জানানো হয়েছিল, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদেরও হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান।
এ লক্ষ্যে তাদেরকে সেনানিবাসে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু কর্মকর্তারা বুদ্ধি করে সেখানে না যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান বলেও সরকারের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়। তার পরিকল্পনার সঙ্গে পাকিস্তানের আরো বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলে জানান অস্থায়ী সরকারের একজন মুখপাত্র। খুব শিগগিরই জড়িত অন্যান্যদের নামও প্রকাশ করা হবে বলে তখন জানানো হয়েছিল।
ঢাকার তৎকালীন গভর্নমেন্ট হাউস থেকে ফরমান আলীর একটি নোটবুক উদ্ধারের খবর সেসময় প্রকাশ হয়েছিল। সেই নোটবুক থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে বলেও তখনকার পত্র-পত্রিকার খবরে উল্লেখ করা হয়।