ঢাকা রবিবার, জানুয়ারী ১২, ২০২৫

Rupalibank

মহাসংকটে পাঠ্যবই মুদ্রণ


স্মার্ট প্রতিনিধি
১৩:৩৭ - বৃহস্পতিবার, জানুয়ারী ৯, ২০২৫
মহাসংকটে পাঠ্যবই মুদ্রণ

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় মেসার্স রেজা প্রিন্টার্স তিনটি লটে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সঙ্গে দুটি লটের চুক্তি করলেও একটি লটে করেনি। ফলে, এই লটের ৩ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৫ কপি বই কবে ছাপা শুরু হবে আর কবে শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে- তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।

রাজধানী ঢাকার আরামবাগের পিবিএস প্রিন্টার্স নামে আরেকটি ছাপাখানা দুটি লটে নবম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপার কাজ পেয়েছে। এর মধ্যে একটি লটে ১ লাখ ১১ হাজার পাঠ্যবই ছাপিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও এখনো চুক্তিই করেনি। ফলে, এই লটের বই ছাপাও শুরু হয়নি। জানা গেছে, শুধু ওই দুটি ছাপাখানাই নয়, এরকম ১৯টি ছাপাখানা বিভিন্ন লটে এনসিটিবির সঙ্গে বই ছাপানোর জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়নি। ফলে পাঠ্যবই ছাপানো শুরু করার বাধ্যবাধকতাও নেই তাদের। কোথাও চুক্তি হচ্ছে, কোথাও চুক্তি নেই, আবার একক দরপত্রে ৪০ ছাপাখানাকে কাজ দেয়া- এমন অরাজকতার মধ্য দিয়ে চলতি বছরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ চলছে।

প্রসঙ্গত, এবার ১১৬টি ছাপাখানায় পাঠ্যবই ছাপা হচ্ছে। এর মধ্যে ৪০টি ছাপাখানাকে ফর্মা প্রতি বেশি টাকা দিয়ে একক দরপত্রে কাজ দেয়া হয়েছে। অথচ দরপত্রের শর্তে বলা আছে, অন্তত তিনটি ছাপাখানা অংশ না নিলে দরপত্র প্রক্রিয়াই শুরু করা যাবে না। কিন্তু দ্রুত পাঠ্যবই ছাপাতে বিধি ভেঙে একক দরপত্রে কাজ দেয়া হলেও নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যবই ছাপানো যায়নি। বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হলেও ৪০ কোটির কিছু বেশি বইয়ের মধ্যে এখনো ১০ কোটি বই ছাপাতে পারেনি এনসিটিবি। এরকম পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষার্থীদের বই পাওয়া নিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান ও শিক্ষা উপদেষ্টার দু’রকম বক্তব্যে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বই না পেয়ে শিক্ষার্থীদের হাহাকারও বেড়েই চলছে। পরিস্থিতি উত্তরণে ৬২টি ছাপাখানায় এনসিটিবি ২ জন করে মনিটরিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে বলেছে, পাঠ্যবই ছাপা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মনিটরিং কর্মকর্তাদের ২৪ ঘণ্টা ছাপাখানায় থাকতে হবে। এমন আদেশ পেয়ে তারা ছাপাখানাগুলোতে চলে গেছেন।

এদিকে দশম শ্রেণির জন্য এবার নতুন করে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবে। কিন্তু এখনো বই না দেয়ায় তাদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে অন্যান্য শ্রেণির বই ধীরগতিতে ছাপানো হচ্ছে। দশম শ্রেণির বই পূর্ণগতিতে (আগে ছাপিয়ে) ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে গণঅভ্যুথানে শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর তারিখ ভুল হওয়ায় বইটি ছাপা বন্ধ রাখা হয়েছে। পাণ্ডুলিপি সংশোধনের পর নতুন করে ছাপতে হওয়ায় এই বইটিও সহসাই পাবে না শিক্ষার্থীরা। অন্য শ্রেণির সব বইও আগামী এপ্রিলের আগে না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর মধ্যে রোজা থাকায় মার্চে পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ ধীর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর পাঠ্যবই ছাপাতে ফর্মাপ্রতি বেশি দাম দিলেও ছাপাখানা মালিকরা কাগজের সংকট দেখিয়ে ছাপা কমিয়ে দিয়েছেন। এনসিটিবি ছাপাখানাগুলোর এমন সিদ্ধান্তকে চক্রান্ত হিসেবে দেখছে। পাশাপাশি পিবিএস প্রিন্টার্স, প্রিন্ট প্লাস প্রিন্টার্সসহ একাধিক ছাপাখানায় ছাপানো পাঠ্যবইয়ে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে পিবিএস প্রিন্টার্সের ছাপানো নবম শ্রেণির একটি বইয়ে এবং প্রিন্ট প্লাস প্রিন্টার্সের ছাপানো বইয়ে ৭০-এর বদলে ৬৬ ও ৬৫ জিএসএম পাওয়া গেছে। জানতে চাইলে প্রিন্ট প্লাসের মালিক মো. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, আমার প্রতিষ্ঠানের ছাপানো পাঠ্যবইয়ে কীভাবে জিএসএম কম হওয়ার কথা এনসিটিবি বলেছে তা চ্যালেঞ্জ করেছি।

তিনি বলেন, বইয়ে জিএসএম কম হয়েছে তা আমার সামনে মেপে দেখান। এনসিটিবি পরে আর মাপেনি। পিবিএস প্রিন্টার্সের মালিক মো. সিরাজুল ইসলাম খান পিন্টু বলেছেন, কয়েকটি বইয়ে জিএসএস কম হওয়ার কারণে আমরা বইগুলো প্রত্যাহার করে নতুন করে ছাপিয়ে দিয়েছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এনসিটিবির যথাযথ পরিদর্শন ছাড়া যেমন ছাপাখানায় বই ছাপানো শুরু হয় না, তেমনি পিডিআই (পোস্ট ডেলিভারি ইন্সপেকশন) ছাড়া বই ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে ট্রাকে উঠতেই পারে না। অথচ এই দুই কাজেই এনসিটিবি গাফিলতির পরিচয় দিয়েছে। ফলে নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপা হয়েছে।

কিছু ছাপাখানা নিম্নমানের পাঠ্যবই দেয়ায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, অভিযোগ পাওয়া গেলে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে। আগেও অভিযোগ এসেছে, তখন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, তার মানে কখনোই নেয়া হবে না তা ঠিক নয়। এবার এই ছাপাখানাগুলো বুঝবে নিম্নমানের  পাঠ্যবই দিলে কী হয়। চেয়ারম্যান আরো বলেন, এবার ছাপাখানাগুলোতে গত বছরের চেয়ে ফর্মাপ্রতি টাকাও বেশি দেয়া হয়েছে। তারপরও তারা বই দিতে পারছে না। এজন্যই ছাপাখানাগুলোতে মনিটরিং কর্মকর্তা পাঠানো হয়েছে।

এদিকে এনসিটিবির মনিটরিং কর্মকর্তা নিয়োগের সমালোচনা করেছেন ছাপাখানার মালিকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত তিনজন ছাপাখানা মালিক গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, পাঠ্যবই ছাপাতে এনসিটিবি কী শুরু করেছে তা আমরা জানি না। আগেও এনসিটিবি আমাদের কাছ থেকে পাঠ্যবই ছাপিয়ে নিয়ে গেছে। এবারের মতো এত বিশৃঙ্খলা আগে দেখিনি। তারা বলেন, মনিটরিং কর্মকর্তা ছাপাখানায় এসে নির্দেশ দিচ্ছেন, ২৪ ঘণ্টাজুড়ে মেশিন চালিয়ে বই ছাপাতে হবে। একটি মেশিন টানা ২৪ ঘণ্টা কীভাবে চলে- এমন প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, মেশিনটিকে তো বিশ্রাম দিতে হবে। সে ২৪ ঘণ্টা চলতে পারবে না। ২৪ ঘণ্টা চালালে এক সপ্তাহের মধ্যে মেশিন নষ্ট হয়ে যাবে। তখন পাঠ্যবই কোথা থেকে ছাপাবে?

কাগজ নিয়ে সিন্ডিকেট, শুল্কমুক্ত আমদানি দাবি: আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। এ জন্য অনেক বই ছাপানো চলছে। তাছাড়া, বছর শুরু উপলক্ষে ডায়েরি, ক্যালেন্ডার ছাপা হচ্ছে, সেখানেও কাগজ লাগছে। আছে নোট-গাইড বই ছাপানোর ব্যবসা। সেখানেও লাগছে কাগজ। সবমিলিয়ে বছরের শুরুতে কাগজের চাহিদা তুঙ্গে থাকে। এর ফলে, একশ্রেণির ব্যবসায়ী কাগজ নিয়ে সিন্ডিকেট করেন। এর আগে বইয়ের কভারে ব্যবহারের জন্য আর্ট পেপার নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করেছিলেন। সরকার সেই সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়ায় আর্ট পেপার সহজলভ্য হয়েছে। ছাপাখানার ব্যবসায়ীরা বলেছেন, আর্ট পেপার নিয়ে সরকার যেভাবে সিন্ডিকেট ভেঙেছে ঠিক সেইভাবে কাগজের সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে পাঠ্যবই ছাপানো দ্রুততর হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ছাপাখানার মালিক বলেন, এক সপ্তাহ আগেও ৮৫ ব্রাইটনেসের একটন কাগজের দাম ছিল এক লাখ ১০ হাজার টাকা। গতকাল সেই কাগজের টনপ্রতি দাম ২০ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার। এক সপ্তাহ আগে ৮২ ব্রাইটনেসের যে কাগজের টনপ্রতি দাম ছিল ১ লাখ, সেই কাগজের দাম গতকাল ২০ হাজার টাকা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, কাগজ সিন্ডিকেটের কারণেও ছাপাখানার মালিকরা বই ছাপছেন না। তার মতে, সরকার যদি বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির অনুমতি দেয় তাহলে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কাগজের সিন্ডিকেট যেমন ভাঙবে তেমনি পর্যাপ্ত পরিমাণ কাগজ পেয়ে দ্রুতগতিতে বই ছেপে দেবেন প্রেস মালিকরা। এতে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে সব বই ছাপা শেষ হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে চলে যাবে।

বই নিয়ে ভিন্ন মত: পুরো পরিস্থিতি জানার পরও এনসিটিবি চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলে যাচ্ছেন, ২০ জানুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়ে যাবে। যেখানে ১৯টি প্রেস চুক্তিই করেনি সেখানে বই কোথা থেকে পাবে- তা নিয়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ চলতি শিক্ষাবর্ষে সব শিক্ষার্থী কবে নাগাদ সব পাঠ্যবই পাবে তা জানেন না বলে জানিয়েছেন। উপদেষ্টা বলেন, আমরা (বই ছাপা) কার্যক্রম শুরু করেছি দেরিতে। আমাদের বই পরিমার্জন করতে হয়েছে। বইয়ের সিলেবাস, কারিকুলাম নতুন করে করতে হয়েছে। বইয়ের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বিদেশে কোনো বই ছাপানো হচ্ছে না। দেশের সক্ষমতা কত সেটা এবারই প্রথম দেখা যাচ্ছে। এতে করে তো দেরি হবেই। কবে নাগাদ সব শিক্ষার্থী বই পাবে জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, কবে নাগাদ সবাই সব বই পাবে এটা আমি জানি না। ছাপাখানার মালিকরা বলেছেন, পাঠ্যবই নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা সঠিক কথা বলেছেন। এনসিটিবি চেয়ারম্যান মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছেন।

অন্যদিকে গত মঙ্গলবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিগত সরকারের আমলে বই ছাপায় কিছু অসাধু চক্র গড়ে উঠেছিল। চক্রটি এবারো সক্রিয় ছিল। তারা শুরু থেকে অসহযোগিতা করেছে। এ কারণে বই ছাপানোর কাজে কিছুটা বিঘ্ন ঘটেছে। ভবিষ্যতে হয়তো এই সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যাবে। সরকার আশা করছে, চলতি মাসের মধ্যেই বই ছাপা এবং বিতরণ কাজ সম্ভব হবে। পাঠ্যবই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের প্রায় ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার পাঠ্যবই বিতরণ করার কথা শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সোমবার পর্যন্ত ১১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৭১৬টি পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে এবং বিতরণ হয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়া চলমান আছে। তিনি বলেন, পাঠ্যবই ছাপানোর জটিলতা ছিল আগে থেকেই। বেশিরভাগ বই ভারত থেকে ছাপানো হতো। অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার বই দেশেই ছাপানো হবে। যার কারণে সব বই এবার বাংলাদেশ থেকে ছাপানো হচ্ছে। এটার জন্য সাময়িক অসুবিধা হচ্ছে, দেরি হচ্ছে। তার জন্য সরকার আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সরকার মনে করে এর কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। তার একটা অন্যতম দিক হচ্ছে আমাদের ছাপা কাজে ১০-১২ লাখ শ্রমিক জড়িত। অর্থনৈতিকভাবে তারা লাভবান হচ্ছেন।