ঢাকা রবিবার, জানুয়ারী ১২, ২০২৫

Rupalibank

হঠাৎ কেন এই ভ্যাট বৃদ্ধি, কী অবস্থা অর্থনীতির


স্মার্ট প্রতিবেদক
৮:২২ - শনিবার, জানুয়ারী ১১, ২০২৫
হঠাৎ কেন এই ভ্যাট বৃদ্ধি, কী অবস্থা অর্থনীতির

২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশে। দ্বিতীয় প্রান্তিকেও যে এ হার তেমন একটা বাড়বে, তার লক্ষণ নেই। সরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যানেই এ চিত্র উঠে আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, অর্থবছরের প্রথম চার মাসের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এ হার গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। শুধু তা–ই নয়, এ সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি কমার অর্থ, দেশে নতুন বিনিয়োগ কমেছে। ২০২৩ সালের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময়ে ভোগ্যপণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ।

সরকারের পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে এনবিআর গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৬২ শতাংশ কম রাজস্ব আহরণ হয়েছে; আগের বছর একই সময়ে যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ।

এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ৬৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়েছে। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগের নেওয়া ঋণের ৫৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এতে সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেয়নি। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ৮ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে সেটা ছিল ঋণাত্মক ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা।

আরেকটি খবর হলো, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত সঞ্চয় কর্মসূচিগুলোর (স্কিম) মুনাফার হার বাড়ানো হচ্ছে। সঞ্চয়পত্রের ধরন অনুযায়ী সুদহার হবে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ সরকার সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে আরও বেশি অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করছে।

এসব পরিসংখ্যান দেওয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার যে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন পণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধি করেছে, তার কারণ অনুসন্ধান। বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকার ভ্যাট বাড়িয়েছে। সে কারণের পাশাপাশি মূল বিষয় হলো, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। এমনকি আগের বছরের একই সময়ে তুলনায় তা কমেও গেছে।

বাস্তবতা হলো, পৃথিবীতে যেসব দেশের কর-জিডিপির অনুপাত সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। গত ১৫ বছরে দেশের জিডিপি কয়েক গুণ হলেও রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বাড়েনি, বরং কমেছে। এর মধ্যে আবার প্রত্যক্ষ কর বা আয়করের অনুপাত কম। সে জন্য ভ্যাট বাড়িয়ে ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা। কিন্তু সমস্যা হলো, ভ্যাট ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান। ভ্যাট বৃদ্ধি করে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অন্যায্য। কোভিড শুরু হওয়ার পর থেকে এ সমস্যা প্রকট হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে তা আরও তীব্র হয়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপদ বেড়েছে। আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির শর্তের কারণে সরকারের ভর্তুকি কমানো হচ্ছে। এতেই চাপে পড়ছে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশে কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। কর ফাঁকির টাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেশে থাকে না, পাচার হয়ে যায়। প্রভাবশালীদের কর ফাঁকি বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ নেই বলা যায়। বরং বারবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সরকার কর ফাঁকিতে একরকম উৎসাহ দিয়ে আসছে। এ ছাড়া রয়েছে নানা ধরনের করছাড়। এসব ছাড়ের কারণে সরকারের রাজস্ব অনেকটা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি গবেষণায় দেখা গেছে, আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমেই বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়। সব মিলিয়ে একদিকে বাংলাদেশ রাজস্ব আদায় করতে পারছে না, অন্যদিকে রাজস্ব ফাঁকিও ঠেকাতে পারছে না।

এ পরিস্থিতিতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে নিম্ন প্রবৃদ্ধির বাস্তবতা। এত দিন উচ্চ প্রবৃদ্ধির মধ্যে কর ফাঁকির প্রবণতা যতটা টের পাওয়া যেত, এখন নিম্ন প্রবৃদ্ধির মধ্যে তা আরও বেশি টের পাওয়া যাবে। যাকে বলে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে। রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতাও কম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় হচ্ছে জিডিপির ১৩ শতাংশ। ভারতে এই হার ২৮ দশমিক ৮, ভিয়েতনামে ২০ দশমিক ৪, মালয়েশিয়ায় ২২ দশমিক ৩, যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যয় ৩৬ দশমিক ৮, সুইডেনে ৪৯ দশমিক ৪ আর ফ্রান্সের সরকারি ব্যয় জিডিপির তুলনায় ৫৭ শতাংশ।

সংস্কার কার্যক্রম

২০২৪ সালে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর অর্থনীতিতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। গত ১৫ বছরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক খাত। এই খাতের সংস্কারে জোর তৎপরতা চলছে। কিছু ফলও পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের কাছাকাছি চলে গেছে। বেড়েছে রিজার্ভ, যদিও এর সঙ্গে আমদানি কমে যাওয়ার যোগ আছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হচ্ছে না। প্রথমত, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রভাব পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছু উৎপাদনমুখী কারখানা। দ্বিতীয়ত, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি যেটা জরুরি, সেটা হলো আস্থা; কিন্তু সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সে আস্থায় চিড় ধরেছে। স্বাভাবিকভাবেই এ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে না।

দেশে অনেক দিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়িয়েই যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে ঋণের সুদহার, যদিও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিশ্লেষকেরা বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; এর সঙ্গে সমন্বিতভাবে রাজস্ব নীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। একদিকে নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে; এ বাস্তবতায় প্রবৃদ্ধির গতি যেমন কমে যাবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিও কমবে না। এ জন্য অর্থনীতিতে স্ট্যাগফ্লেশন (উচ্চ মূল্যস্ফীতি + নিম্ন প্রবৃদ্ধি + উচ্চ বেকারত্ব) তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়, প্রবৃদ্ধির জন্য কিছুটা মূল্যস্ফীতি প্রয়োজন। কিন্তু এখন মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হলেও প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেকারত্বের সমস্যা। দেশে গত এক দশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধির মধ্যেই কাঙ্ক্ষিত হারে কর্মসংস্থান হয়নি। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন। তাঁদের ভাষ্য, এটা ছিল কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। এখন প্রবৃদ্ধির হার দুইয়ের নিচে নেমে এসেছে। এ বাস্তবতায় কর্মসংস্থান পরিস্থিতির যে আরও অবনতি হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। ঢাকা মহানগরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দৌরাত্ম্য দেখে বেকারত্ব পরিস্থিতির বাস্তবতা বোঝা যায়।

ভোগ্যপণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বেড়ে যায়—এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত সূত্র। অন্যদিকে মূলধনি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা কমে যায়। এ সবকিছুর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধির ওপর; বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে যা ৪ শতাংশে নামবে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ; এমনকি পরিসংখ্যানগত সংশোধন (আগের সরকারের বিরুদ্ধে পরিসংখ্যান বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ ছিল) সত্ত্বেও এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই নিম্ন বিনিয়োগ ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে তা কতটা অর্জনযোগ্য, সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

মোদ্দাকথা হলো, অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন নিয়ে আসার মতো পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকার এখনো নেয়নি। আগে রাজনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে যেভাবে ধনীদের তোষণ করার নীতির সমালোচনা হতো, শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্তও সেই প্রকৃতির, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার পিছিয়ে যাচ্ছে বলেই দেখা যাচ্ছে। সূত্র- প্রথম আলো