মা-ই সন্তানের জন্য তুলনামূলকভাবে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেন। যেমন গর্ভধারণ, দুধপান, রাত জেগে সন্তানের তত্ত্বাবধানসহ নানাবিধ কষ্ট একমাত্র মা-ই সহ্য করেন। তা ছাড়া সন্তানের প্রতি মা-ই সবচেয়ে বেশি যত্নবান ও বেশি আদর-সোহাগ করে থাকেন। আর তাই মা-ই সন্তানের আদর-যত্ন পাওয়ার বেশি হকদার।
একজন সাহাবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকার সবচেয়ে বেশি কার? নবিজি (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। সাহাবি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, নবিজি (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। সাহাবি আবারো জানতে চাইলেন, নবিজি (সা.) বললেন, তোমার মায়ের। এরপর সাহাবি জানতে চাইলে নবিজি (সা.) বললেন, তোমার বাবার। (বুখারি ও মুসলিম)
পবিত্র কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি মানুষকে মা-বাবার সঙ্গে সদয় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অতি কষ্টে গর্ভে ধারণ করেছেন এবং অতি কষ্টে তাকে প্রসব করেছেন। তার গর্ভধারণ ও দুধপান ছাড়ানোর সময় লাগে ৩০ মাস। অবশেষে যখন সে তার শক্তির পূর্ণতায় পৌঁছে এবং ৪০ বছরে উপনীত হয়, তখন সে বলে, হে আমার রব! আমাকে সামর্থ্য দাও, তুমি আমার ওপর ও আমার মা-বাবার ওপর যে নিয়ামত দান করেছ, তোমার সে নিয়ামতের যেন আমি কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারি এবং আমি যেন ভালো কাজ করতে পারি, যা তুমি পছন্দ করো। আর আমার জন্য তুমি আমার বংশধরদের মধ্যে সংশোধন করে দাও। নিশ্চয় আমি তোমার কাছে তাওবা করলাম এবং নিশ্চয় আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’। (সূরা: আহকাফ, আয়াত: ১৫)
কোরআনের আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি মানুষকে তার মা-বাবার সঙ্গে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় ২ বছরে; সুতরাং আমার শুকরিয়া ও তোমার মা-বাবার শুকরিয়া আদায় করো’। (সূরা: লুকমান, আয়াত: ১৪)
মা-বাবার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমার রব আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। তাদের একজন অথবা উভয়েই যদি বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো’। (সূরা: বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৩)
মা-বাবার জন্য দোয়া শিখিয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে,
رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا
অর্থ: ‘হে আমার রব! তাদের প্রতি দয়া করুন; যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে লালন-পালন করেছেন’। (সূরা: বনি ইসরাইল, আয়াত: ২৪)
আরো বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তার সঙ্গে কাউকে শরিক কোরো না এবং পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করো’। (সূরা: নিসা, আয়াত: ৩৬)
নবজাতক হজরত ঈসা (আ.)-এর মুখে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা ভাষা ফুটিয়ে দিলেন; তখন তিনি বলেছিলেন, ‘নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা, আমাকে কিতাব (আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল) দেওয়া হয়েছে এবং তিনি (আল্লাহ) আমাকে নবী করেছেন। আর আমাকে বরকতময় করা হয়েছে আমি যেখানেই থাকব; আর আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সালাত ও জাকাত বিষয়ে, যত দিন আমি জীবিত থাকব’।
ঈসা (আ.) আরো বলেন, ‘আর আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আমি যেন আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করি (অনুগত ও বাধ্য থাকি); আমাকে করা হয়নি উদ্ধত অবাধ্য ও দুর্ভাগা হতভাগ্য’। (সূরা: মারিয়াম, আয়াত: ৩০-৩২)
বনি ইসরাইলের নবী মুসা (আ.) এর প্রতিও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি বনি ইসরাইল থেকে এই অঙ্গীকার নিয়েছি যে তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে’। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ৮৩)
পিতা-মাতা সন্তানের সম্পদের অধিকারী ও উত্তরাধিকারী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর পিতা-মাতা উভয়ের প্রত্যেকের জন্য (সন্তানের) সম্পদের এক–ষষ্ঠাংশ যদি তার সন্তান থাকে; আর যদি সন্তান না থাকে, তবে পিতা-মাতাই ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী হবেন, এমতাবস্থায় তার মায়ের জন্য এক-তৃতীয়াংশ’। (সূরা: নিসা, আয়াত: ১১)
শিশুকে স্তন্যদানসংক্রান্ত আলোচনায় বর্ণিত হয়েছে, আর মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে পূর্ণ ২ বছর দুধ পান করাবে, (এটা) তার জন্য যে দুধ পান করাবার সময় পূর্ণ করতে চায়। আর পিতার উপর কর্তব্য, বিধি মোতাবেক মাদেরকে খাবার ও পোশাক প্রদান করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয় না। কষ্ট দেওয়া যাবে না কোনো মাকে তার সন্তানের জন্য, কিংবা কোনো বাবাকে তার সন্তানের জন্য। আর ওয়ারিশের ওপর রয়েছে অনুরূপ দায়িত্ব। অতঃপর তারা যদি পরস্পর সম্মতি ও পরামর্শের মাধ্যমে দুধ ছাড়াতে চায়, তাহলে তাদের কোনো পাপ হবে না। আর যদি তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে অন্য কারো থেকে দুধ পান করাতে চাও, তাহলেও তোমাদের ওপর কোনো পাপ নেই, যদি তোমরা বিধি মোতাবেক তাদেরকে যা দেবার তা দিয়ে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমরা যা কর, সে সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা’। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৩৩)
পিতা-মাতার সন্তুষ্টি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার এক অপূর্ব সুযোগ। যারা এই সুযোগকে কাজে লাগায়নি, হাদিসে তাদের কঠিন হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তির নাক ধুলোয় ধূসরিত হোক! ওই ব্যক্তির নাক ধুলোয় ধূসরিত হোক! ওই ব্যক্তির নাক ধুলোয় ধূসরিত! (অর্থাৎ সে ধ্বংস হোক)। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, কে সে? তিনি বলেন, যে ব্যক্তি মাতাপিতা উভয়কে অথবা তাদের কোনো একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল, অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না, সে ধ্বংস হোক।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৫১)
হিন্দু ধর্মে মা
সনাতন ধর্মে উল্লেখ আছে স্ববংশবৃদ্ধিকামঃ পুত্রমেকমাসাদ্য..’। আবার সন্তান লাভের পর নারী তার রমণীমূর্তি পরিত্যাগ করে মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা করবেন। তাই মনু সন্তান প্রসবিনী মাকে গৃহলক্ষ্মী সম্মানে অভিহিত করেছেন। তিনি মাতৃ গৌরবের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এভাবে- উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা। সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে’। (মনু,২/১৪৫) অর্থাৎ ‘দশজন উপাধ্যায় (ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা একজন আচার্য্যরে গৌরব অধিক, একশত আচার্য্যরে গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব অধিকতর; সর্বোপরি, সহস্য পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানার্হ’। সূত্র: উইকিপিডিয়া।