জো বাইডেন চীনের ফেন্টানিল (মাদক) সম্পর্কিত নীতি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল এখন চীন থেকে আমেরিকায় আসা ফেন্টানিলের কেমিক্যাল প্রবাহ বন্ধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপের পক্ষে। এ নিয়ে শুধু শুল্ক বাড়ানোর কথা নয়, আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসা আমেরিকার ফেন্টানিল সংকট মোকাবিলায় দেশটির দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বড় পরিবর্তন আসতে পারে। প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিমের উপদেষ্টারা চীনের প্রতি আরো আগ্রাসী মনোভাব নেয়ার পক্ষে আছেন, যা ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নীতির চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। ট্রাম্প আগেই সংকেত দিয়েছেন, মাদকদ্রব্যের প্রবাহ রোধ করতে তিনি শুল্ক ব্যবহার করবেন।
২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একটি স্বাগত অনুষ্ঠানেই অংশ নেন - ইন্টারনেট
২৫ নভেম্বর ট্রুথ সোশ্যাল—তার সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এক পোস্টে ট্রাম্প চীন থেকে আসা পণ্যে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক এবং মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আসা পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, এসব দেশ যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে অবৈধ মাদক, ফেন্টানিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাহিত হচ্ছে। ট্রাম্প বলেন, চীনকে মাদক প্রবাহ থামানোর জন্য তিনি বহুবার আলোচনা করেছেন, কিন্তু কোনো ফল আসেনি।
ট্রাম্পের উপদেষ্টারা চীনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে আছেন, যেগুলো ফেন্টানিল ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে, শেষ সিদ্ধান্তটি ট্রাম্পই নেবেন।
২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ৬৫ বছর বয়সী ট্র্যাভিস হেইজ সান ফ্রান্সিসকোতে একটি ব্যাগ দেখাচ্ছেন, যা তার দাবি অনুযায়ী ফেন্টানিল। সিনথেটিক অপিওয়েড সংকটটি পুরো যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটিগুলোকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে - ইন্টারনেট
মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলছে, চীন হলো প্রধান উৎস যেখানে মেক্সিকান কার্টেলগুলো ফেন্টানিল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক উপাদান পাচ্ছে। চীনের অর্থপাচারকারীরা আন্তর্জাতিক মাদক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাইডেন প্রশাসন গত এক বছর ধরে বেইজিংয়ের সঙ্গে এই দুই সমস্যার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আলোচনা করছে, তবে কিছু মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এবং চীনবিরোধী নেতারা হতাশ, তারা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ আরো বাড়াতে হবে।
চীন বিশেষজ্ঞ এবং জর্জ ওয়াশিংটন বুশ প্রশাসনের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা স্টিভ ইয়েটস বলেছেন, "যখন আপনি কিছু করেন না, তখন আপনি শুধু একজন পদপিষ্ট ব্যক্তি"। ইয়েটস, যিনি ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিমের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত নন, কিন্তু ফেন্টানিল নীতির বিষয়ে ট্রাম্পের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন, গত দশ বছরে ৪ লাখের বেশি আমেরিকান সিনথেটিক অপিওয়েড ওভারডোজে মারা গেছেন, যার মধ্যে ইয়েটসের মেয়ে, যিনি গত বছর মারা গেছেন।
ইয়েটস এবং ট্রাম্পের টিমকে পরামর্শ দেয়া অন্যরা বলেন, বেইজিংয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ওয়াশিংটনের দ্রুত এবং নিশ্চিত উপায় হলো, চীনের সেই ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, যেগুলো অর্থপাচারকারীদের এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাসায়নিক বিক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করছে।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড ফিশম্যান বলেন, যেসব বিদেশি ব্যাংককে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তারা আমেরিকান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন করতে পারে না বা মার্কিন ডলার অ্যাক্সেস করতে পারে না। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা করার সক্ষমতা ব্যাপকভাবে সীমিত হয়ে যায়।" তিনি আরো বলেন, ওয়াশিংটন নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাখা মার্কিন সম্পত্তি জব্দ করতে পারে।
ডেভিড অ্যাশার, একজন শীর্ষস্থানীয় সাবেক মার্কিন এন্টি মানিলন্ডারিং কর্মকর্তা, যিনি ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আর্থিক কর্মকাণ্ডকে লক্ষ্য করে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, এটি একটি শক্তিশালী অস্ত্র যা কিছু মার্কিন শত্রু দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে যেমন ইরান এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, তবে কখনো মেক্সিকো এবং চীনের ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি, যেগুলো মাদক চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
ওয়াশিংটনের কনজারভেটিভ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হাডসন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো অ্যাশার বলেন, সব ব্যাংকারদের ওপর নজর রাখতে হবে।" অ্যাশার একটি স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেছেন, ট্রাম্পের ট্রানজিশন টিমের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, যাতে ফেন্টানিল সংকট মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং আর্থিক শক্তির সব দিক নিয়ে একটি সরকারি কর্মী দল গঠন করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
রয়টার্সের সঙ্গে শেয়ার করা পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে :
- ফেন্টানিল বাণিজ্যে যুক্ত চীনা কোম্পানি এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা।
- সবচেয়ে চাহিদাপ্রাপ্ত মাদক পাচারকারীদের জন্য পুরস্কারের পরিমাণ বাড়ানো।
- মেক্সিকান কার্টেলগুলোর বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ এবং ফেন্টানিল বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মনোযোগ বাড়ানো।
- সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমান পদক্ষেপ নেয়া।
চীনা দূতাবাসের এক মুখপাত্র বলেছেন, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকে চীন যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে তা সব ফেন্টানিলের অবৈধ উৎপাদন, পাচার এবং অপব্যবহার রোধ করার জন্য। দূতাবাস সতর্ক করে জানিয়েছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র আরো আক্রমণাত্মক মনোভাব নেয় তবে চীন প্রতিক্রিয়া জানাবে।
এক বিবৃতিতে দূতাবাস জানিয়েছে, "চীন বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, অপবাদ এবং কাল্পনিক অভিযোগ কেবল চীন-যুক্তরাষ্ট্র মাদকবিরোধী সহযোগিতার ভিত্তিকে দুর্বল করবে। চীন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞার অযৌক্তিক ব্যবহার কঠোরভাবে বিরোধিতা করে এবং এর বৈধ অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।"
চীন সরকার সম্পর্কে শত্রুতা ক্যাপিটল হিলে জায়গা করে নিয়েছে ইতোমধ্যে। সেখানে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয়ই বেইজিংকে শাস্তি দেয়ার জন্য বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিছু লোক বিশ্বাস করেন, চীন ইচ্ছাকৃতভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেন্টানিলের মাধ্যমে অস্থির করতে চাইছে।
ট্রাম্প চীনের ওপর মাদকদ্রব্যের কারণে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি হতে পারে একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। অক্টোবর মাসে এক পডকাস্টের সাক্ষাৎকারে, ট্রাম্পের বাণিজ্য বিভাগ পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হাওয়ার্ড লুটনিক বলেছেন, "চীন আমেরিকাকে ফেন্টানিল দিয়ে আক্রমণ করছে।" তিনি উল্লেখ করেন, ট্রাম্প চীনের উপর ২০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করতে পারেন।
প্রচারণার সময় ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দেন, মেক্সিকোর মাদক কার্টেলগুলোকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে ঘোষণা করবেন এবং সেগুলোকে ধ্বংস করতে মার্কিন সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন। তবে এটা স্পষ্ট নয়, ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো বাদেও ফেন্টানিল নিয়ে চীনা ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন কিনা।
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের অনেক সময়ই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতি প্রশংসা, এমনকি ভালোবাসা প্রকাশ করেছিলেন, আর সে সময় যুক্তরাষ্ট্রে এই মাদকের ওভারডোজে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেড়েছিল। রয়টার্সের একটি তদন্তে দেখা গেছে, কীভাবে চীনা বিক্রেতাদের থেকে অনলাইনে সহজে ফেন্টানিলের প্রিকার্স (প্রাথমিক উপাদান) কেনা যায়, যেগুলো তারা গ্যাজেট এবং অন্যান্য সস্তা পণ্য হিসেবে ছদ্মবেশে বিমান দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। এই বাক্সগুলো সাধারণত শুল্ক ছাড়াই কাস্টমস পার হয়ে যায় এবং অন্যান্য চীনা আমদানি পণ্যের মধ্যে মিশে পাচারকারীরা মেক্সিকান মাদক ল্যাবে পাঠিয়ে দেয়। ওয়াশিংটনে এখন দুই দলীয় মনোভাব তৈরি হচ্ছে, যেন চীন এই সোজা পথের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়।
ট্রাম্পের কাছাকাছি রিপাবলিকান মহলে ক্রমবর্ধমান একমত হতে শুরু হয়েছে। তারা মনে করছেন, বেইজিং ফেন্টানিল মহামারীকে আমেরিকার ক্ষতি করার জন্য কাজে লাগাচ্ছে। তারা এপ্রিল মাসে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের চীন সম্পর্কিত সিলেক্ট কমিটির প্রকাশিত একটি দ্বিদলীয় রিপোর্টের দিকে ইঙ্গিত করছে, যা চীনকে ফেন্টানিল সংকটের "চূড়ান্ত ভৌগোলিক উৎস" হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বেইজিং বারবার ওই রিপোর্টের দাবিগুলো নাকচ করেছে। চীনা দূতাবাস তাদের এক বিবৃতিতে বলেছে, চীন ফেন্টানিলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগতভাবে দুর্বল করার একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করার ধারণাটি পুরোপুরি বাস্তবতা ও তথ্যের বিপরীত।