পরিবারকাঠামো অনেক আগেই বদলে গেছে। এখন কোভিড মহামারির পরে মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ধরনেও বদল এসেছে। বদলে যাচ্ছে সামাজিকতার ধরনও। শহরাঞ্চলে যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে একক পরিবার গড়ে উঠেছে অনেক আগেই। একক পরিবারের ধারণা এখন গ্রামেও পৌঁছে গেছে। একটা সময় অবসরে বা ছুটির দিনে যেখানে সবাই আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়া কিংবা বন্ধুদের বাসায় যাওয়ার চল ছিল, পরে সেটা রেস্টুরেন্টে বা এক দিনের জন্য কোথাও বেরিয়ে আসায় রূপ নেয়। কিন্তু কোভিডের পর এখন সবাই একঘরে থেকেও আলাদা। বেড়াতে গেলেও সবাই একা। হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, নয়তো টিভি স্ক্রিনের সামনে।
ইউনিসেফ বলছে, গত কয়েক দশকের যে কোনো সংকটের চেয়েও কোভিড মহামারি বিশ্বব্যাপী শৈশবকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব ও অপব্যবহার থেকে শুরু করে শিক্ষায় ব্যাঘাত শিশুদের মনজগতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। মনোবিদেরা বলছেন, মহামারির বিপর্যয়কর প্রভাব অবশ্যই সম্পূর্ণভাবে প্রতিকার করতে হবে। সারা বিশ্বে অনেক শিশুই অচলাবস্থায় রয়ে গেছে। তারা তাদের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে আগ্রহী, কিন্তু তাদের মনোজগতের পরিবর্তনের কারণে ভাবনার জগত্ আর আগের মতো নেই। একটা পুরো প্রজন্মের ভবিষ্যত্ হুমকির মুখে।
যৌথ পারিবারিক কাঠামো ভেঙে একক পরিবারের মাঝেই এত দিন মানুষ স্বস্তি খুঁজছে, স্বাধীনতা খুঁজেছে। কিন্তু সত্যিই কি মিলেছে, স্বস্তি, স্বাধীনতা—এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সহজ কোনো উত্তরও মিলছে না। এখন তো সেই একক পরিবারের মাঝেও শান্তি মিলছে না মানুষের। বিশ্ব জুড়েই গ্রামীণ সমাজে পরিবারের ধারণা ভিন্ন ছিল। এখন নগরায়ণের ফলে মানুষের চাহিদা, প্রয়োজন বদলে যাচ্ছে। বদল ঘটছে পরিবারের কাঠামোতে, পরিবারকাঠামোর ধারণাতেও। বর্তমান সময়ে মানুষ বড় হওয়ার পরে আর পরিবারের সঙ্গে থাকতে চায় না। যৌথ পরিবার তো ভেঙে গেছে অনেক আগেই। এখন স্বামী-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যে পরিবার, সেখানকার সদস্যরাও একক সত্তা নিয়ে বিরাজ করতে চায়। এক ছাদের নিচে থাকলেও ‘ফ্যামিলি বন্ডিং’টা যেন উধাও হয়ে গেছে।
কোভিড মাহামারির পরবর্তী পর্যায়ে এই ‘ফ্যামিলি বন্ডিং’টাকেই প্রতিষ্ঠার পরামর্ম দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেছেন, আমাদের পারিবারিক বন্ধন দিনে দিনে দুর্বল হয়ে পড়ছে। পরিবারগুলোয় ভঙ্গুরতা বিরাজ করছে। শিশু ও তরুণেরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে, মহামারিতে মানসিক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে আরো নানাবিধ সমস্যাও বাড়ছে। মানুষ এখন অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আছে। আর মানুষ যখন চাপে থাকে, তখন আবেগে আক্রান্ত হয়। আবার অনেকে একা থাকতে চায়। তিনি আরো বলেন, সামাজিক অবক্ষয় কমাতে পরিবারগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। কেউ যেন বিচ্ছিন্ন হতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। একই সঙ্গে দেখতে হবে কারো মধ্যে যেন শূন্যতা সৃষ্টি না হয়। কেননা, হতাশা, শূন্যতা বা বিচ্ছিন্নতার কারণে মানুষ সহিংস আচরণে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নওশিন আফরিন গণমাধ্যমকে বললেন, করোনার সময় দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকায় এখন শিশুরা আরো বেশি ঘরকুনো হয়ে পড়েছে। সে সময় কম্পিউটারে গেম খেলতে দিতে হয়েছে। তা না করলে ওরাই বা সময় কাটাত কী করে! কিন্তু এখন সেই অভ্যাস তো কাটানো যাচ্ছে না। আমি ও আমার স্বামী দুজনেই চাকরি করি। সকালে বের হই, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। বাসায় ফিরেও আমরা যার যার ঘরে একাই সময় কাটাই। ছুটির দিন ছাড়া একসঙ্গে খেতে বসাও হয় না। ফ্যামিলি আছে, কিন্তু বন্ডিংটাই যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
এই তো গত শতকেও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেড়ে ওঠা—সবকিছু ছিল সামগ্রিকভাবে পরিবারকেন্দ্রিক। পরিবারের যে কোনো সদস্যের যে কোনো চাহিদা পূরণ ছিল রীতিমতো পারিবারিক সিদ্ধান্ত থেকে। নিজের সন্তানের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসত পরিবারের প্রধানের কাছ থেকে। দাদা, চাচা, মা, চাচি, চাচাতো ভাইবোনেরাও সমান অংশীদার ছিল পরিবারের যে কোনো ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে। পরিবারের যৌথ কাঠামো এই সামাজিক বন্ধন ও নৈতিক বন্ধন দৃঢ় করত। বড়দের মানা, প্রত্যেক সম্পর্ককে সম্মান করা—এ সবকিছুই তারা শিখত গুরুজনদের কাছ থেকে। সেই পারিবারিক সম্পর্ক এখন অনেক আলগা হয়ে গেছে। এখন চারপাশে জীবন ও জীবিকা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। ফলে অসুখী দাম্পত্য, সন্তানের লেখাপড়া, ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত যে, চাওয়া-পাওয়া আর উন্নতির চক্রে ঘুরছে সবকিছু। এমনকি মেকি বন্ধুত্বও এখন চাকরি বা প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক রীতিনীতি পালটাচ্ছে। মানুষের মূল্যবোধ বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে সমাজের অনুশাসন, কাঠামো। মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা যত বাড়ছে, জীবনযাপনের স্বাধীনতাও ততটাই ভোগ করতে চাইছে। পরিবারগুলো ভাঙছে। সমাজও তার আদল বদলাচ্ছে। জীবনযাপনের পুরোনো রীতিগুলোও পালটাচ্ছে।
‘আমাদের ছোটবেলাটা অন্যরকম ছিল। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলো সব ছোটবেলার। আমরা সব ভাইবোন আর চাচাদের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে এক বাড়িতে এক ছাদের নিচে বেড়ে উঠেছি। ‘আমার’ বলে কিছু ছিল না। সব ছিল ‘আমাদের’। দাদা ছিলেন পরিবারের প্রধান। আমরা কী পড়ব, কী করব—সবকিছু মা-বাবা দাদার সঙ্গে ঠিক করে করতেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা সেই পরিবেশ পেল না। বলছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবদুল মোহাইমিন।
বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোই শুধু নয়, সারা বিশ্বের সামাজিক কাঠামোর প্রধান অংশ হচ্ছে পরিবার। যৌথ পরিবার সর্বভারতীয় সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও যৌথ পরিবারপ্রথা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। নগরায়ণের অনেক বিরূপ প্রভাবের একটি হলো যৌথ পরিবারগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়ে একক পরিবার হওয়া। তবু টিমটিমে প্রদীপশিখার মতো এখনো বয়ে চলেছে পরিবার সংস্কৃতির এই ধারা। কিন্তু আশপাশে চোখ মেলে একটিও যৌথ পরিবার ইদানীং নজরে আসে না।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সাহিত্যিক ড. মোহিত কামাল গণমাধ্যমকে বললেন, পরিবার একটা বড় শিক্ষার জায়গা। যৌথ পরিবারগুলো শিশুদের বেড়ে উঠতে খুব বড় ভূমিকা রাখত। পরিবারের প্রতিটি সদস্যই তাদের আচরণে নিয়ন্ত্রণ রাখত। মা-বাবার দ্বন্দ্ব, হতাশা—এসব শিশুদের সামনে তারা প্রকাশ করত না। কারণ এতে সবাই তা জেনে যাবে। যখন যৌথ পরিবার ছিল, তখন এসব তারা নিয়ন্ত্রণ করত। এখন পরিবারে তো নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই।
ড. মোহিত কামালের মতে, আমাদের ছেলেমেয়েরা অসামাজিক হয়ে উঠছে মূলত মা-বাবার কারণে। শিশুর চরিত্র গঠনে মা-বাবাকেই সবচেয়ে বেশি সময় দিতে হবে। খেলার সুযোগ না থাকলে প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে আত্মীয়-বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যাওয়া। এটা করলেও শিশুরা সামাজিকতা শিখবে। সেখানে অন্য শিশুদের সঙ্গে মিশে যেমন তাদের সহ্যক্ষমতা বাড়বে, তেমনি মা-বাবার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে ব্যবহার, পরিমিতিবোধ, ভদ্র আচরণ দেখেও তারা শিখবে। কিন্তু এসব আড্ডায় বড়রাও খুব একটা নিজেদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। সবচেয়ে বড় কথা, শিশুর বেড়ে ওঠার সময় পারিবারিক আবহের মধ্যে রাখতে হবে। তাহলে সে মানবিক হবে।