সেই ঘূর্ণিঝড় সিডর, ইয়াস, আইলা, মহাসেন, বুলবুলের আঘাতের ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি বাংলাদেশের উপকূলীয় উপজেলার মানুষেরা। ধারাবাহিক ভাবে প্রতিবছরই এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে আবার বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি আরো শক্তিশালী (ঘনীভূত) হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। এটি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
এবারের ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রেমাল’। এ নামটি ওমানের দেওয়া। যার অর্থ বালি। গত বছর মোখা, তার আগের বছর আম্ফানের ভয়ংকর রূপ দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। তবে এর আগেও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে জানমালের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ে। প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ। প্রাণহানির পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ভীষণ ক্ষতি হয়। যা পুষিয়ে নিতেও সময় লাগে বছরের পর বছর।
এবার চলুন ধারাবাহিক ভাবে জেনে নিই বাংলাদেশে প্রলয়ংকারী যত ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে-
ঘূর্ণিঝড় মোখা: ২০২৩ সালের ১৪ মে স্থানীয় সময় বেলা ৩টার দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানে, যার প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও ঝড় হয় এবং প্রতি ঘণ্টায় ১৭৫ মাইল পর্যন্ত বেগে প্রবল বাতাস বয়ে যায়। কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষেরা। বিশেষ করে গরীব ও নিম্নবিত্তদের কাঁচা ঘরবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে এই ঘূর্ণিঝড়ে। সবমিলিয়ে ঝড়ের প্রভাবের শিকার হয়েছেন ৩ লাখ ৩৪ হাজার মানুষ। যার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে উপকূলীয় মানুষের। এমনকি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষেরা।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং: এটি ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতকে প্রভাবিত করেছিল। সিত্রাং শব্দের অর্থ পাতা। ২২ অক্টোবর আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উপকূল থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রে সিত্রাং গঠিত হয়ে ধীরে ধীরে তীব্রতর হতে হতে ২৫ অক্টোবর প্রথম প্রহরে উচ্চ-প্রান্তের ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বরিশালের কাছে বাংলাদেশের ওপর আছড়ে পড়ে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে দেশের ১৪ জেলায় ৩৩ জন মারা যান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট করে। প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান: ২০২০ সালের ২০ মে বাংলাদেশে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান। এটি একটি ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী ভারতের পূর্বাংশে এবং বাংলাদেশে আঘাত হানে। বাংলাদেশের মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতেই আম্পানের আঘাত ছিল তীব্র। বাঁধগুলো ভাঙার ফলে পটুয়াখালী জেলার অন্তর্গত গলাচিপা, কলাপাড়া, এবং রাঙ্গাবালীসহ ১০টি গ্রাম ডুবে যায়। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ১০ কোটিরও বেশি লোক বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল। প্রায় ৩,০০০টি চিংড়ি এবং কাঁকড়া খামার বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যায়। সাতক্ষীরা জেলার, পূর্ব দুর্গাবতীতে, একটি বাঁধের কিছু অংশ ৪ মিটার (১৩ ফুট) উঁচু বন্যার জলে ভেসে যায়, যার ফলে ৬০০ টি বাড়িঘর ডুবে যায়।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: বার বার দিক বদল করে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল এই ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর স্থলভাগ দিয়ে বাংলাদেশে আসায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়। ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন। ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। ক্ষতি হয় সুন্দরবনেরও।
ঘূর্ণিঝড় ফণী: ২০১৯ সালের ৩ মে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে ৯ জনের মৃত্যু হয়। তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।
ঘূর্ণিঝড় মোরা: ২০১৭ সালের ৩০ মে ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় মোরা’র আঘাতে কক্সবাজার উপকূলের শতাধিক বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। বেশকিছু গাছপালা উপড়ে পড়েছে। তবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ঘূর্ণিঝড় মোরা’র প্রভাবে উত্তাল রয়েছে সাগর। ঘূর্ণিঝড়টি সোমবার থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মহেশখালী-কুতুবদিয়ার উপকূল ছুয়ে চট্টগ্রাম, হাতিয়া ও সন্দীপের দিকে অগ্রসর হয়।
ঘূর্ণিঝড় মহাসেন: ২০১৩ সালের মে মাসের শুরুর দিকে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণাংশে নিম্নচাপজনিত কারণে উৎপত্তি ঘটে মহাসেনের। কার্যত স্থির থাকলেও ১০ মে তারিখে ঘণিভূত অবস্থায় চলে যায়। পরবর্তীতে এটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে মৌসুমের প্রথম নামাঙ্কিত ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে রূপান্তরিত হয়। ১৪ মে এটি উত্তর-পূর্বাংশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কার্যত জনজীবন অচল হয়ে পড়ে।
ঘূর্ণিঝড় আইলা: ২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে আইলা। ঘূর্ণিঝড়টি জন্ম নেয় ২১ মে ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে। এর ব্যাস ছিলো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডরের থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে, তবে পরে বাতাসের বেগ ৮০-১০০ কিলোমিটার হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি, সিডর থেকে তুলনামূলক কম হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় সিডর: আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ২০০৭ সালের ৯ নভেম্বর একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। ১১ নভেম্বর আবহাওয়ায় সামান্য দুর্যোগের আভাস পাওয়া যায়। এর পরের দিনই এটি ঘূর্ণিঝড় সিডরে পরিণত হয়। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে এটি দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করে এবং বাংলাদেশে একটি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রীয় অংশ ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টার পর বাংলাদেশের পাথরঘাটায় বালেশ্বর নদীর কাছে উপকূল অতিক্রম করে। ঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলীয় জেলাসমূহে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ঝড়ো হাওয়াসহ বিপুল পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। এক রিপোর্টে বলা হয়- ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের প্রায় ৬ লাখ টন ধান নষ্ট হয়। সুন্দরবনের পশুর নদীতে বেশকিছু হরিণের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায় এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়। ঝড়ের প্রভাবে প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এ ঝড়ে প্রায় ২ লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা যায়।
বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড় ১৮৭৬: প্রাণহানি ও ভয়ংকরের দিক থেকে পৃথিবীর ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাসে ষষ্ঠ স্থান দখল করে আছে বাকেরগঞ্জ ঘূর্ণিঝড়। ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর বাকেরগঞ্জের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় এই প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। এটি ‘দ্য গ্রেট বাকেরগঞ্জ ১৮৭৬’ নামেও পরিচিত। এ সময় মেঘনার মোহনা এবং চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালী উপকূলে তীব্র ঝড়ো জলোচ্ছ্বাস ও প্লাবন সংঘটিত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জের নিম্নাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়ে যায়। ঝড়ে আক্রান্ত ছাড়াও ঝড় পরবর্তী বিভিন্ন অসুখ ও অনাহরে মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আনুমানিক ২ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এই ঘূর্ণিঝড়ে। এরও বেশি মানুষ মারা যায় ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী মহামারি এবং দুর্ভিক্ষে।
ভোলার ঘূর্ণিঝড় ১৯৭০: এ ঘূর্ণিঝড়টি ১৯৭০ সালের ১৩ নভেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে। এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড়সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ এবং সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকরতম প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটি। এ ঝড়ের কারণে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। যার অধিকাংশই গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সমুদ্র সমতলের ভূমিতে জলোচ্ছ্বাসে ডুবে মারা যান। এটি সিম্পসন স্কেলে ‘ক্যাটাগরি ৩’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল।
ঘূর্ণিঝড়টি ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হয় এবং ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এর গতিবেগ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে (১১৫ মাইল) পৌঁছায় এবং সে রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। এতে ওইসব এলাকার বাড়ি-ঘর, গ্রাম ও শস্য স্রোতে তলিয়ে যায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল তজুমদ্দিন উপজেলা। সেখানে ১ লাখ ৬৭ হাজার অধিবাসীর মধ্যে ৭৭ হাজার জনই প্রাণ হারায়।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়: নিহতের সংখ্যা বিচারে স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি। এটি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘটিত হয়। ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড়টি। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ৬ মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত করে এবং এর ফলে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। এছাড়া প্রায় ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। ঘূর্ণিঝড়টি স্থলভাগে আক্রমণের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০ এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয়। এতে সন্দ্বীপ, মহেশখালী, হাতিয়া দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল শিশু ও বৃদ্ধ। ধারণা করা হয়- প্রায় ২০ লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে বিপজ্জনক স্থানে অবস্থানের কারণে আক্রান্ত হয়। সেসময় প্রায় ১০ লাখ ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ১ কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়ে পড়ে।