উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে নোয়াখালী। দুই সপ্তাহের বেশি সময় স্থায়ী এই বন্যায় ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। জেলায় পানিবন্দি হয়ে রুটি-রুজি হারিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করেছে প্রায় ২২ লাখ মানুষ। যাদের মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৩ লক্ষাধিক মানুষ। বিশেষ করে বন্যায় নোয়াখালী সদর, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ি ও সেনবাগ উপজেলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি।
নোয়াখালী সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে উপজেলা প্রশাসন শুরু থেকে তৎপর ছিলো। যার ফলে বহু মানুষ ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়া মানুষকে একদিনের জন্য না খেয়ে থাকতে হয়নি।
সদর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২৫৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২৭ হাজার ২ শত পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করে। আশ্রিত এসকল পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবারের প্যাকেট বিতরণের পাশাপাশি চাল, ডাল, তেল সরবরাহ করা হয়। নিরাপদ পানির জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাওয়ার স্যালাইন দিয়েও সহায়তা করা হয়েছে। পাশাপাশি বন্যাকবলিত এই উপজেলার বানভাসিদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তি।
উপজেলার পশ্চিম দেবীপুর সরকারি প্রাথমিক আশ্রয়ন কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেছে, এবারের বন্যায় ওই এলাকায় হাটু থেকে কোমর, কোথাও কোথাও গলা পরিমাণ পানি ওঠে মানুষের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশুর খামার এবং মৎস্য ঘের ভেসে গেছে। এতে মানুষের আয়-রোজগারের সকল পথ বন্ধ হয়ে গেছে। শৌচাগার, ড্রেন, পুকুর ও খাল-বিল ভেসে বন্যার পানির সঙ্গে গভীর-অগভীর নলকূপগুলো পানিতে ডুবে গেছে। এতে মানুষের বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয়রা বলেন, বন্যার শুরু থেকে আমাদের আশ্রয়ন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুকনো খাবার, চাল-ডাল-তেল, বিশুদ্ধ পানি ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আখিনূর জাহান নীলা। তিনি যেভাবে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাতে মনে হয়েছে আখিনূর জাহান নীলা যেন একজন স্বেচ্ছাসেবক। তাঁর ভূমিকায় আপ্লুত উপজেলার বানভাসি মানুষ।
তবে উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় এখনো পানি নামেনি। ফলে বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকটসহ ডায়রিয়ার মতো মহামারি। মানুষের বাড়িঘর, আসবাবপত্র, রাস্তাঘাট, আয়-রোজগারের মাধ্যম নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয়রা এখন ত্রাণ সহযোগিতা না চেয়ে, বিশুদ্ধ পানি, ঔষুধ ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চারটি প্ল্যান্ট থেকে সব উপজেলায় বিশুদ্ধ পানিসহ ২০ লাখ পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া বেগমগঞ্জে সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
তবে জেলা সদরের বেশিরভাগ বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেওয়া বিশুদ্ধ পানি কিংবা পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট পাননি বলে অভিযোগ করেন।
সদর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির যোগান দিতে জার্মান ভিত্তিক সংস্থা এ.এস.বি’র অর্থায়নে বাংলাদেশী সংস্থা সি.ডি.ডি এবং নোয়াখালীর স্থানীয় সংস্থা ‘এন-রাশ’ এর সহযোগিতায় বন্যার্ত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণের ৪টি মেশিন স্থাপন করা হচ্ছে। বুধবার সকালে জেলা সদরের এওজবালিয়া ইউনিয়নের বেদে পল্লীতে একটি পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন স্থাপন করা হয়।
নোয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, বন্যা যখন শুরু হয়, তখন আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার আখিনূর জাহান নীলা মহোদয় নিজে বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে মানুষকে আশ্রয়ন কেন্দ্রে আসতে বলেন এবং তাদের খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। যেখানেই মানুষের দুর্ভোগ দেখেছেন, সেখানেই আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে চলেছেন। তাঁর দায়িত্বশীল আন্তরিকতায় পুরো উপজেলায় বহু মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন।
এবারের বন্যায় সদর উপজেলার ইউএনওসহ ছাত্র সমন্বয়কদের ভূমিকার ভুয়সী প্রশংসা করেছেন সুশীল সমাজের একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। তাদের মতে, অভিজ্ঞ ইউএনও আখিনূর জাহান নীলা এবং ছাত্র সমন্বয়করা যেভাবে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেটা আগামীর সুন্দর একটি বাংলাদেশের দৃশ্য হিসেবে উপস্থাপিত হবে।
সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আখিনূর জাহান নীলা বলেন, বন্যার্তদের সহায়তার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি এনজিও, সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো ও ছাত্র সমন্বয়কদের প্রদানকৃত ত্রানের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করায় কেউ না খেয়ে থাকেনি। প্রথমদিকে বেসরকারি বিভিন্ন এনজিও বিচ্ছিন্নভাবে ত্রানসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদানে সমন্বয়টা ঠিক হয়ে উঠেনি। এটা বন্ধ করে বেসরকারি একটি এনজিও (ব্র্যাক) কে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বন্যা পরবর্তী মহামারি ও পুনর্বাসনের জন্যেও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।