নোয়াখালী জেলায় একের পর এক গড়ে ওঠছে অবৈধ ইটভাটা। এইসব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে পড়ানো হচ্ছে কাঠ। ফসলী জমি ও বসতি ঘিরে গড়ে ওঠা ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি বিপর্যয় গড়ছে পরিবেশের। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয়রা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় বৈধ ইটভাটার সংখ্যা রয়েছে ১১২টি, অবৈধ ইটভাটা ৪১টি। তবে সরেজমিনে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, জেলায় অবৈধভাবে চলছে শতাধিক ইটভাটা। এইসব অবৈধ ইটভাটায় দেদারছে ফসলি জমির ওপরের টপ সয়েল (মাটি) কেটে শিশু শ্রমের মাধ্যমে তৈরী ইট বাংলা সেমনির মাধ্যমে কাঠ কেটে পড়ানো হচ্ছে। আবার স্থায়ীয় পর্যায় থেকে সংগ্রহকৃত গাছ লাকড়ি করার জন্য ভাটার মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে অবৈধ করাত কল। ইটভাটার মাটি ও গাছ বোঝাই ভারি যানবাহন চলাচলে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক।
সরেজমিন জেলার সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নে অবৈধভাবে চালানো হচ্ছে মের্সাস আলিফ ব্রিকস, মের্সাস তাহেরা ব্রিকস ও মের্সাস এ.কে.বি ব্রিকস। পাশের ইউনিয়ন চরজুবলীতে চলছে মের্সাস আল্লাহর দান ব্রিকস। ওই উপজেলায় ১৭টি ইটভাটার মধ্যে ১৩টিই অবৈধ।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুর রব, নুর হোসেন, আবুল বাশারসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, অবৈধ এসব ইটভাটার কালো ধোয়ায় আমাদের বাড়ির নারিকেল, সুপারি, পেয়ারাসহ ফল গাছে ফল আসে না। জমির ফসলও নষ্ট হয়ে যায়। ধোয়ায় ঘরের ছালের টিন জং ধরে গেছে। ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। বিবশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ করেও কোন প্রতিকার পাননি বলে অভিযোগ তাদের।
স্থানীয় সমাজকর্মী ইমাম উদ্দিন বলেন, শুকনো মৌসুমে ইট তৈরীর জন্য ফসলি জমির ওপরের টপ সয়েল (মাটি) বৈধ-অবৈধ ইটভাটায় নিয়ে যাওয়ার কারণে সুবর্ণচরে ধান ও রবি শস্য উৎপাদন কমে গেছে। এতে কৃষির ক্ষতিসহ পরিবেশের ভারসাম্য নস্ট হচ্ছে। দ্রুত অবৈধ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তোলেন এই সমাজকর্মী।
একই চিত্র ফুটে ওঠে জেলার দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায়ও। ওই উপজেলায় ২০ ইটভাটা দেদারছে চলছে। সবগুলো ইটভাটাই বাংলা, পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে বাড়ছে রোগ-ব্যাধি, ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি বিপর্যয় গড়ছে পরিবেশের। হাতিয়া উপজেলায় উপেক্ষিত হচ্ছে সরকারি আইন।
ইটভাটার সংখ্যা ও বৈধতার বিষয়ে জানতে হাতিয়া উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ উদ্দিনের মুঠোফোনে কল করলে তিনি জানান, হাতিয়ায় ২০টি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটাগুলোর বৈধতা রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি জানান, কার কি কাগজ আছে, তা তো জানিনা। তবে সবগুলো ভাটাই বাংলা সেমনিতে চলছে।
জেলার সদর উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ৭টি। এরমধ্যে ৫টি ইটভাটাই অবৈধভাবে চালানো হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইটভাটাগুলোর কাগজপত্র দেখে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
একই চিত্র জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, কবিরহাটসহ সব কটি উপজেলায়। জেলাজুড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটায় পরিবেশ বিপর্যয়ে দেখা দিয়েছে রোগ-ব্যাধি, উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে ফসলের।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর হুশিয়ারি থাকলেও অজানা কারণে নিশ্চুপ রয়েছেন নোয়াখালীর পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই চলছে এসব অবৈধ ইটভাটা। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা কোটি কোটি টাকার ইটভাটায় মাঝে-মধ্যে লোক দেখানো অভিযানে ৫০ থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা করে জনসাধারণকে দেয়া হয় শান্তনা। অভিযানের পর পরই আবার দেদারছে শুরু হয় অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম। এভাবে প্রতিটি অবৈধ ইটভাটার মালিক বছরে ৪-৫ লাখ টাকা খরচ করে নিয়ে যান কোটি কোটি টাকার সুবিধা। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।
ইটভাটায় কাঠ ব্যবহার সম্পূন্ন নিষিদ্ধ এবং বাংলা সেমনিও পরিবেশ সম্মত নয় এমনটি স্বীকার করে সুবর্ণচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুরাইয়া আক্তার লাকী বলেন, ইটভাটার বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর ও বন বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমরা সেখানকার কর্মকর্তদের সঙ্গে কথা বলে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে শীঘ্রই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
পরিবেশ অধিদপ্তর নোয়াখালীর উপপরিচালক মিহির লাল সরদার বলেন, সরকারের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে আমরা অবৈধ ইটভাটার তালিকা প্রণয়ন করেছি এবং অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ৫টি অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
অভিযানের পরও কিভাবে ভাটাগুলো পুনরায় চালানো হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই ধরনের অভিযোগ পেলে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে অভিযুক্ত অবৈধ ইটভাটাগুলো গুড়িয়ে দেয়া অথবা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, পরিবেশের জন্য বিপর্যয় এসব অবৈধ ইটভাটা বন্ধের পরিকল্পনা নয়, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চান স্থানীয়রা।