ঢাকা শুক্রবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৫


https://www.ajkerbazzar.com/wp-content/uploads/2025/06/728X90_Option.gif

এক নম্বরে জীবন শুরু ও সমাপ্তি


স্মার্ট ডেক্স
১২:০০ - মঙ্গলবার, আগস্ট ১২, ২০২৫
এক নম্বরে জীবন শুরু ও সমাপ্তি

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ক্রমশ আরো সহজ, স্বচ্ছ ও গতিশীল করে তুলেছে। তবু, নাগরিক জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক আজও জটিলতার কাছে পরাস্ত পরিচয় প্রমাণের ক্ষেত্রে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে নাগরিককে বারবার একই ধরনের কাগজপত্র, ফর্ম ও তথ্য জমা দিতে হয়। জন্মনিবন্ধনের জন্য আলাদা ফর্ম, জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য ভিন্ন, শিক্ষাব্যবস্থা ও চাকরির জন্য আলাদা আলাদা তথ্য, ভোটার তালিকায় নাম উঠাতে ও জমি রেজিস্ট্রি করতে আরেকটি, পাসপোর্ট কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্সে আরো আলাদা কিছু। সরকারি-বেসরকারি, প্রতিষ্ঠান-সংগঠন প্রতিটি জায়গায় বারবার নিজের পরিচয় প্রমাণের কঠিন ঝামেলা।

এই বিশৃঙ্খল তথ্য ব্যবস্থায় সত্য ও গোপনীয়তা হীন তথ্য, ভুল তথ্য এবং ভুয়া তথ্যের প্রবেশ বাধা দিতে পারে না কেউ। ফলে নাগরিকের পরিচয় হয় অস্পষ্ট, তথ্য হয় বিচ্ছিন্ন, এবং প্রশাসনের দক্ষতা ও ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় ব্যক্তি নিজেও তার বংশ, ঐতিহ্য, জীবনী সঠিকভাবে বহন করতে পারেন না।

তাই প্রশ্ন হলো সব তথ্য যদি একটি মাত্র একক, সার্বজনীন, আজীবন ব্যবহারযোগ্য নাগরিক পরিচয় নম্বর (একক পরিচয় নম্বর) এর সঙ্গে যুক্ত করা যেত, যা জন্ম থেকে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকত, তবে কি নাগরিক জীবনের এই বহুবিধ জটিলতা দূর হয়ে যেত; কীভাবে এটি আমাদের পরিচয় ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর, নির্ভুল করে তুলতে পারত?

এই প্রশ্নের উত্তরে একক পরিচয় নম্বর-ই এক যুগান্তকারী ধারণা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি শুধু নাগরিকের জীবনকে সহজ করবে না, রাষ্ট্রের সেবা প্রক্রিয়াকেও করবে দ্রুত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল। এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হতে পারে কীভাবে একক পরিচয় নম্বর আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হতে পারে।

জীবনচক্র: ধরা যাক রাজধানীর একটি হাসপাতালে এক নারী সন্তান প্রসব করতে এলেন। তিনি যদি পূর্বেই একটি ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নম্বর পান, এবং সেটি রাষ্ট্রীয় তথ্যকেন্দ্রে সংরক্ষিত থাকে, তাহলে সেই নম্বর ব্যবহার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সহজেই জানতে পারবে তার স্বাস্থ্য ইতিহাস, রক্তের গ্রুপ, অ্যালার্জি, অপারেশনের বিবরণ, এমনকি গর্ভকালীন চিকিৎসা সম্পর্কেও। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে এবং জীবনরক্ষাকারী সিদ্ধান্ত নিতে তাদের আর দ্বিধা করতে হবে না।

শিশুটি যখন জন্ম নেবে তখনই তার জন্য একটি একক পরিচয় নম্বর স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেনারেট হবে। এই নম্বরে থাকবে- তার জন্মের স্থান ও সময়, পিতা-মাতার নাম ও পরিচয় নম্বর, জন্মের সময় তার শারীরিক চিহ্ন বা বায়োমেট্রিক তথ্য, প্রসব-সংক্রান্ত মেডিকেল ইতিহাস (জন্ম পরিচয়)। এখানেই শেষ নয় এই নম্বরের মাধ্যমেই শিশুটির টিকা কার্যক্রম শুরু হবে। যতবারই সে টিকা নেবে, সেই রেকর্ড তার একক পরিচয় নম্বরের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে চিকিৎসকরা ভবিষ্যতে সহজেই জানতে পারবেন, সেকোনো ভ্যাকসিন নিয়েছে, আদৌ সময়মতো নিয়েছে কিনা, তার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল ইত্যাদি।

শিক্ষাক্ষেত্রে: শিশুটি যখন প্রথম বা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হবে, তখন আর বাবা-মাকে আলাদা করে জন্মসনদ, মেডিকেল সার্টিফিকেট, ঠিকানা প্রমাণ ইত্যাদি জমা দিতে হবে না। শুধু তার একক শিক্ষা-নম্বর প্রদান করলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জানতে পারবে শিশুটিকে, তার পিতা-মাতা কারা, তার কোনো স্বাস্থ্যগত বা মানসিক বিশেষ চাহিদা রয়েছে কিনা, সে পূর্বে কোনো শিশু বিকাশ কেন্দ্রে পড়েছে কিনা এবং তার শেখার অগ্রগতি কেমন।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক, তারপর উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিটি স্তরেই এই একক নম্বর শিক্ষার্থীর জীবনপঞ্জির মতো কাজ করবে। তার ফলাফল, উপস্থিতি, সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ, আচরণমূল্যায়ন এমনকি পছন্দের বিষয়সমূহও এই নম্বরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

এই তথ্য সর্বক্ষেত্রে থাকার অর্থ হলো বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কমিটি আগেই জানতে পারবে শিক্ষার্থীর যোগ্যতা ও মনোভাব। তার মেধা মূল্যায়ন করা যাবে সামগ্রিকভাবে। কোনো ভুয়া সনদ তৈরি বা জমা দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, দেশে কিংবা বিদেশে ভর্তি প্রক্রিয়া সহজ হবে এবং শিক্ষার্থী প্রতারণার শিকার হবে না।

মেধাবী কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বাছাই করাও সহজ হবে। সরকার, শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি কোনো সংগঠন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশের যেকোনো প্রান্তের প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীকে খুঁজে বের করতে পারবে এবং তাকে যথাযথভাবে প্রণোদনা বা বৃত্তি দিতে পারবে। এর জন্য আর আলাদাভাবে কোনো সুপারিশ বা মধ্যস্থতার প্রয়োজন হবে না।

একজন শিক্ষার্থী তার পূর্ববর্তী সকল শিক্ষাজীবনের তথ্য অনায়াসে জানাতে পারবে। কারণ তার অতীতের শিক্ষা-ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই ভবিষ্যতের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জন সম্ভব হবে।

কর্মক্ষেত্রে: কর্মজীবনে প্রবেশ করতে গেলে একজন চাকরিপ্রার্থীকে নানা ধরনের জটিলতা ও বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে সিভি জমা দেওয়া, একই তথ্য বারবার সরবরাহ করা, পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকারের প্রতিটি ধাপে নিজের পরিচয় ও যোগ্যতা নতুন করে প্রমাণ করা এ যেন একটি দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর প্রক্রিয়া।

অন্যদিকে, নিয়োগদাতাদের ক্ষেত্রেও সঠিক প্রার্থী বাছাই করা, তার অতীত অভিজ্ঞতা যাচাই, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা বোঝা কিংবা তার আগের বেতন ও দক্ষতার ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্যায়ন করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। ফলে নিয়োগ প্রক্রিয়া অনেক সময়ই স্বচ্ছ ও কার্যকর হয় না, যা প্রার্থী ও নিয়োগকর্তা উভয়ের জন্যই সময়, শ্রম ও অর্থের অপচয় ঘটায়।

এই প্রেক্ষাপটে একটি একক পরিচয় নম্বর চালু করা হলে দেশের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একই নম্বর ব্যবহার করে একজন নাগরিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, পূর্ব অভিজ্ঞতা, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা, বেতন কাঠামো, দক্ষতা ও সাফল্যের সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণ করা গেলে নিয়োগের ক্ষেত্রে আর কোনো জটিলতা থাকবে না। নিয়োগকর্তারা সহজেই একক পরিচয় নম্বরের মাধ্যমে প্রার্থীর প্রোফাইল যাচাই করতে পারবেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে স্বল্প সময়ে খুদেবার্তা বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে নিয়োগের প্রস্তাব দিতে পারবেন। প্রার্থীরও আর বারবার দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে না।

এভাবে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রে নিয়োগপ্রক্রিয়া আরো দ্রুত, স্বচ্ছ ও দক্ষ হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে একটি কেন্দ্রীয় নিয়োগ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হলে প্রার্থী তার আগ্রহ, পছন্দ ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পছন্দের প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব বেছে নিতে পারবেন। এতে প্রার্থীর সঠিক মূল্যায়ন যেমন হবে, তেমনি প্রতিষ্ঠানও দক্ষ ও যোগ্য কর্মী খুঁজে পাবে যা দেশের কর্মসংস্থান ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।

বিয়ে ও পারিবারিক: বিয়ের ক্ষেত্রে তথ্য গোপন, পূর্ব ইতিহাস আড়াল করা, পরিচয় জালিয়াতি এসব ঘটনা সমাজে কম নয়। একক পরিচয় নম্বর ব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তি যদি বিয়ের জন্য প্রস্তাব পায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খুব সহজেই জানতে পারবে- সে আগেও বিয়ে করেছে কিনা, আইনগতভাবে বৈবাহিক সম্পর্কের বৈধতা আছে কিনা, তার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কেমন, অপরাধ বা নির্যাতনের অভিযোগ আছে কিনা। এতে করে প্রতারণা কমবে, সমাজে স্বচ্ছতা বাড়বে, এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলোর ভিত্তি হবে বিশ্বাসনির্ভর।

দেশত্যাগ: আজকের বৈশ্বিকায়নের যুগে বিদেশ গমন ও আন্তর্জাতিক ভ্রমণ অনেকের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখনো পাসপোর্ট ও ভিসা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে গিয়ে হাজারো মানুষকে নাম, জন্ম তারিখ, ঠিকানা ও পরিচয় প্রমাণের জটিলতা ও হয়রানির শিকার হতে হয়। একই তথ্য বারবার দাখিল করা, ম্যানুয়াল যাচাই এবং প্রশাসনিক দীর্ঘপ্রক্রিয়া কেবল ভ্রমণকারীদের ভোগান্তি বাড়ায় না, পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের ওপরও বাড়তি চাপ তৈরি করে। এমন পরিস্থিতিতে নাম্বার একক পরিচয় নম্বর চালু হলে এ সমস্যার একটি যুগান্তকারী সমাধান আসতে পারে। কারণ সেখানে তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা কম।

একটি মাত্র অনন্য নাগরিক নম্বর ব্যবহারের মাধ্যমে পাসপোর্ট আবেদন থেকে শুরু করে বিদেশযাত্রা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ হয়ে উঠবে ঝামেলাবিহীন ও প্রযুক্তিনির্ভর। আবেদনকারীকে আর আলাদা করে ফরম পূরণ করতে হবে না; পূর্বের কোনো দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা বা তিনি বৈধ নাগরিক কিনা এসব তথ্য তাৎক্ষণিক যাচাই সম্ভব হবে। ইমিগ্রেশন পয়েন্টে একক পরিচয় নম্বর স্ক্যান করলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভ্রমণ ইতিহাস, ভিসা প্রত্যাখ্যানের রেকর্ড এবং আইনগত কোনো জটিলতার তথ্যও দেখা যাবে। এতে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে দীর্ঘ লাইন ও হয়রানি কমবে, সময় বাঁচবে, এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাও আরো জোরদার হবে।

এভাবে একক পরিচয় নম্বর চালু হলে বিদেশগমন প্রক্রিয়া যেমন সহজ হবে, তেমনি দেশের নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল ইমিগ্রেশন ব্যবস্থায়ও নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।

আইন ও অপরাধ: ধরে নেয়া যাক, কেউ একটি গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়েছে। আদালতে বিচার চলবে, তদন্ত চলবে, সাক্ষী ও আলামত সংগ্রহ হবে। যদি তার একক পরিচয় নম্বর থাকে, তাহলে সে পূর্বে কোনো অপরাধে জড়িত ছিল কিনা জানা যাবে, অপরাধের ধরণ এবং পুনরাবৃত্তি বোঝা যাবে। মানসিক রোগ বা অতীত ট্রমা ছিল কিনা তা জানা যাবে। সাজা নির্ধারণে বিচারক সহজেই মানসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বুঝতে পারবেন এর ফলে ন্যায়বিচার হবে আরো কার্যকর এবং প্রমাণের ভিন্নতা কমে আসবে।

নাগরিক অধিকার নাগরিক অধিকার তথা মৌলিক অধিকার সকলের জন্য সমানভাবে নিশ্চিত হওয়া উচিত। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে যখন কেউ এক জেলায় ভোটার হন, অন্য জেলায় কর্মসূত্রে থাকেন, তখন ভোটাধিকার প্রয়োগে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষ করে দূরবর্তী কিংবা পরস্পর ভিন্ন জায়গায় অবস্থানকারী ভোটারদের জন্য ভোট দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

একক পরিচয় নম্বর একক পরিচয় নম্বর ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব। এই ব্যবস্থায় নাগরিক যেকোনো স্থান থেকে মোবাইল ভোটিং অথবা ডিজিটাল পরিচয় যাচাইয়ের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। এর ফলে ভোটারদের সঠিক ভোটাধিকার নিশ্চিত হওয়া সহজ হবে এবং ভোটদান প্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বচ্ছ ও নিরাপদ হবে।

অন্যদিকে, জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে আজও নানা ধরনের জালিয়াতি ও অস্বচ্ছতার ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের যদি নির্দিষ্ট একক পরিচয় নম্বর থাকে, তাহলে জমির মালিকানা নিশ্চিত করা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় যাচাই, মামলার অবস্থান জানা এবং কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সহজ হবে। এ ছাড়াও, দূরদূরান্ত এলাকায় বসবাসরত মানুষের সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হবে, যা সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

ফলশ্রুতিতে জমি সংক্রান্ত প্রতারণা ও জালিয়াতির হার কমে যাবে এবং জনসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত হবে। একক পরিচয় নম্বর ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন দেশের নাগরিক অধিকার ও সম্পত্তি স্বত্ব রক্ষায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এর ফলে জমি নিয়ে প্রতারণা ও জাল কাগজের প্রচলন কমবে।

উত্তরাধিকার: নিশ্চিত ও সুশৃঙ্খল উত্তরাধিকার প্রক্রিয়া আজকের তথ্যভিত্তিক যুগে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। একজন নাগরিকের মৃত্যু হলে হাসপাতাল, পৌরসভা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তা দ্রুত একক পরিচয় একক পরিচয় নম্বর ডেটাবেজে আপডেট করা গেলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৃত্যু নিবন্ধন, মৃত্যুর কারণ সংরক্ষণ, এবং ওয়ারিশদের তালিকাভুক্তি সহজ ও নিশ্চিত হয়। এর ফলে উত্তরাধিকার সনদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে দালালদৌরাত্ম্য ও অপ্রয়োজনীয় ঝামেলা ব্যাপকভাবে কমে আসে।

এ ছাড়া, পরিবারে অযাচিত বিরোধ বা কোন্দল কমে, কাফন-দাফনের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, আইনি জটিলতা দূর হয় এবং মৃত ব্যক্তির ঋণ, বীমা কিংবা অন্যান্য দায়-দায়িত্ব দ্রুত নির্ণয় ও নিষ্পত্তি সম্ভব হয়। অজানা বা অনাকাঙ্ক্ষিত মামলা, চাপ কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের দাবি-দাওয়া পরিবারের শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে না।

এই আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় তথ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে একদিকে নাগরিকের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষা এবং অন্যদিকে পরিবার ও সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই একক পরিচয় নম্বর ভিত্তিক এই ব্যবস্থা কার্যকর করলে দেশের উত্তরাধিকার প্রক্রিয়া হবে আরো সুশৃঙ্খল, স্বচ্ছ ও দ্রুততর।

পরিকল্পনা: বর্তমান তথ্যভিত্তিক যুগে উন্নয়ন এবং নীতিনির্ধারণের সফলতা মূলত নির্ভর করে সঠিক, সময়োপযোগী ও ব্যাপক তথ্যের উপস্থিতির ওপর। বাংলাদেশে নানা ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষা সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য নির্ভরযোগ্য ডেটার অভাব এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একক পরিচয় নম্বর চালু হলে সরকারের জন্য দেশের জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দিক যেমন শিক্ষার্থী সংখ্যা, কর্মক্ষম জনগণ, স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা, নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি, মৃত্যুহার এবং শিক্ষার হারসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত সহজ ও কার্যকর হবে।

এই তথ্যসমূহের মাধ্যমে নীতিনির্ধারণীরা বাস্তবসম্মত ও তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যা দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে গতিশীল করবে। ফলে সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং সমাজের বিভিন্ন দুর্বল ক্ষেত্রে কার্যকর হস্তক্ষেপ সম্ভবপর হবে। তাই একক পরিচয় নম্বর বাস্তবায়ন আমাদের দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে, যা তথ্যের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে সামগ্রিক উন্নয়নের পথ সুগম করবে।

নিরাপত্তা: রাষ্ট্র বা সরকারের সামনে আজকের ডিজিটাল যুগে নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলো অন্যতম জটিল ও সংবেদনশীল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা, তথ্যের অবৈধ ব্যবহার রোধ, এবং প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাইবার হামলা প্রতিরোধ করাই এখন সরকারের প্রধান দায়িত্বের মধ্যে পড়েছে। সফল ও নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল সেবা প্রদানের জন্য রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে, তথ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা যেমন ডেটা এনক্রিপশন এবং গোপনীয়তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ সম্পূর্ণ কার্যকর, নাগরিকের সম্মতি ছাড়া তাদের তথ্য ব্যবহার সংক্রান্ত কঠোর বিধিনিষেধ বজায় রয়েছে, এবং হ্যাকিং কিংবা ডেটা চুরির মতো সাইবার ঝুঁকিগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পাশাপাশি, এই ব্যবস্থাগুলোর জন্য যথাযথ ও আধুনিক প্রযুক্তি অবকাঠামো গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। নাগরিকদের আস্থা অর্জন ও তাদের তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে ডিজিটাল পরিবর্তনের সুফল সমগ্র সমাজে নিরাপদে পৌঁছাতে পারে। রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকদের আস্থা অর্জন করা এবং প্রয়োজনীয় সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

আমাদের আহ্বান: সরকার যেন দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করে, পাইলট প্রকল্প চালু করে এবং নাগরিকদের জন্য এই একক, সার্বজনীন ও আজীবন নাগরিক পরিচয় নম্বর বাস্তবায়ন শুরু করে।